পরিবেশ ও বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিন
আহসান হাবিব:
|
প্রথম দেখায় মনে হতে পারে শীতের কুয়াশা ভেদ করে ছুটে চলা নগরজীবন ,তবে গল্পটা এখানে ভিন্ন। চলতি ডিসেম্বরে রাজধানীতে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশেরও বেশি মারা যায় বায়ু দূষণজনিত কারণে। অথচ বায়ুদূষণ রোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) মাত্রা অনুযায়ী, আবারো বায়ু দূষণে ঢাকার নাম শীর্ষ অবস্থানে চলে এসেছে। এতে বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ২৪৬। একিউআই অনুযায়ী, ঢাকার পরে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের লাহোর, মাত্রা ২৩০। আর তৃতীয় অবস্থানে ১৩৪ মাত্রা নিয়ে আছে দিল্লি। অপরিকল্পিত নির্মাণ আর অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের ধোঁয়া বায়ু দূষণের প্রধান কারণ। এছাড়া নতুন একটি কারণে বাতাস দূষিত হচ্ছে, তা হলো বর্জ্য পোড়ানো। ঢাকায় এখন নানা ধরনের বর্জ্য পোড়ানো হয় এবং এটা দিনদিন বাড়ছে। শিল্প কারখানার মধ্যে স্টিল রিরোলিং মিল বায়ু দূষণ করে, এরপরে আছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। এর পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে চলছে চরম দায়িত্বহীনতার প্রতিযোগিতা। এছাড়াও ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থপনা, শিল্পদূষণ, মেগা প্রকল্পসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কারণে প্রতিদিন হাজার টন ধূলিকণা বাতাসে মিশে বায়ুদূষণের মাত্রাকে বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে গেছে।সাধারনত বায়ুর প্রতি ঘনমিটারে অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিক মাত্রা 65 মাইক্রোগ্রাম। তবে রাজধানীর বেইলি রোডের ব্যস্ততম সড়কে বুধবার দুপুরে এর মাত্রা 160 থেকে 200 মাইক্রো গ্রাম হয়েছে।যা গত মাসেও ছিল সহনীয় মাত্রার কাছাকাছি। যা এই মাসে বেড়ে তিনগুণের কাছাকাছি হয়েছে। Economist Intelligence Unit (EIU)এর তথ্য মতে পৃথিবীর অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় সিরিয়ার দামেস্কের পরেই স্থান করে নিয়েছে ঢাকা।২০১৭ সালের ২৫ শে জানুয়ারি তথ্য অনুযায়ী এই মান বেড়ে হয়েছে ৩৬১ একিউআই যা চরমভাবে অস্বাস্থ্যকর এবং ২০২২ সালে এসে স্বাভাবিক মাত্রার ৭ গুন ওপরে অবস্থান করেছে।Total Environment Journal-এর এক গবেষণায় ঢাকার বাড়িতে সাধারণের চেয়ে দুইগুণ বেশি ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়াও আর্সেনিক ,ক্রোমিয়াম এবং ক্যাডমিয়াম এর পরিমাণ বায়ুতে অনেকগুণ বেড়ে গেছে যা ক্যান্সারের জন্য দায়ী।ঢাকা শহরের বাতাসে দূষণকারী কণাগুলোর 58 শতাংশ শহর এবং এর আশেপাশে ইটভাটাগুলোর থেকে আসে।58% রাস্তা এবং মাটির ধুলা 10% গাড়ি 8% জৈব বর্জ্য পোড়ানো এবং 6 শতাংশ অন্যান্য উৎস থেকে আসে। এই দিকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত চলতি বছরও এক দিনের জন্য নির্মল বাতাস পায়নি রাজধানীবাসী। এটি দুঃখজনক। এর আগেও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে প্রতি বছর এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয় শুধু দূষিত বায়ুর কারণে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ট্রান্সফরমেশন (বেস্ট) শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তা সত্ত্বেও পরিবেশ বায়ুদূষণমুক্ত করা যাচ্ছে না।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ কৃষি জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে। একই সঙ্গে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ ভাবে জলবায়ু অভিবাসী হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বায়ু দূষণের জন্য মানবদেহে বিশেষ করে শ্বাসযন্ত্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব রয়েছে এবং শ্বাসযন্ত্রের নানান রোগ, হৃদরোগ, স্নায়ুতন্ত্র,চুলপড়া এবং চর্মসহ বিভিন্ন রোগ। বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়তে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগের পাশাপাশি বর্তমান পরিবেশ বিষয়ক নীতিতে আরো বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসা প্রয়োজন। তাই যত্রতত্র সিটি কর্পোরেশনের সংগৃহীত বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করতে হবে, শিল্পকারখানর বায়ু দূষণ কমাতে ইটিপি ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে, যানবাহন ও নৌযান থেকে দূষণ এবং কালো ধোঁয়া নির্গমন রোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর খোঁড়াখুঁড়ি কাজের সমন্বয় সাধন করা ও বায়ু দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করতে ব্যাপক জন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বায়ুদূষণসহ অন্যান্য দূষণ যদি সহনীয় পর্যায়ে না রাখা যায়, তবে অচিরেই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। বায়ুদূষণ কমাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যে কারণে এবং যেসব উৎসের কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে, সেগুলো রোধ করতে হবে। ঢাকার চারপাশে গড়ে ওঠা হাজার হাজার ইটভাটা, পরিবেশগত নিরাপত্তাহীন শিল্পকারখানা এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ঢাকার বায়ু দূষণ রোধে বেশি বেশি গাছ লাগানো দরকার। দূষণের জন্য দায়ী বিষয়গুলো সেগুলো এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ঢাকাবাসীরা চরম দুর্দশায় পড়ে যাবে। এ জন্য অভিজ্ঞ জনদের অভিজ্ঞতা, পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ আমলে নিতে হবে। লেখক: ডিপার্টমেন্ট অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। ডেল্টা টাইমস্/সিআর/এমই
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |