নিরাপদ প্রসব : মায়ের অধিকার
সেলিনা আক্তার
|
প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে সামগ্রিকভাবে শারীরিক, সামাজিক ও মানসিক কল্যাণের সমন্বয়ে সন্তান জন্মদানের পরিপূর্ণ প্রক্রিয়াকে বোঝায়। একজন গর্ভবতী নারীকে শুরু থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াকে প্রসূতিসেবা বা অ্যান্টেনেটাল চেকআপ বলা হয়। গর্ভাবস্থা কোনো রোগ নয়। এটি নারীর জীবনের একটি স্বাভাবিক পরিবর্তন। মাতৃত্বের স্বাদ পেতে নারীকে এ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একজন নারীকে তার গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পর গর্ভাকালীন সেবা অর্থাৎ প্রসব–পূর্ববর্তী সেবা,বাচ্চা প্রসবের সময় সেবা ও প্রসব–পরবর্তী সেবা এই তিনটি পর্যায়ে সেবা গ্রহণ করতে হয়। এই তিনটি পর্যায়ের সেবার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একজন নারীকে গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পর দুই মাসের মধ্যে অবশ্যই চিকিৎসকের সেবা নিতে হবে। ন্যূনতম চারবার চিকিৎসকের কাছে চেকআপে যেতে হবে। প্রথমবার ৪ মাসের মধ্যে ,দ্বিতীয়বার ৬ থেকে ৭ মাসের মধ্যে, তৃতীয়বার অষ্টম মাসে এবং চতুর্থবার নবম মাসে।সবচেয়ে ভালো হয় যদি এক মাস পর পর সাত মাস পর্যন্ত চেকআপ করা যায় । সাত মাস পর থেকে দুই সপ্তাহ পরপর ৯ মাস পর্যন্ত এরপর এক সপ্তাহ পরপর প্রসব পর্যন্ত চেকআপ করা সম্ভব হলে সবচেয়ে ভালো হয় । যদি নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ না থাকে ও ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা না হয়, সে ক্ষেত্রে কমপক্ষে চারবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিয়মিত প্রসূতিসেবা নিলে গর্ভকালীন জটিলতা ও প্রসবজনিত বিপদগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। জটিলতা ছাড়া একজন মা সুস্থ ও সুন্দরভাবে সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারেন। প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলে মায়ের প্রসব নিরাপদ হয়, মাতৃমৃত্যুর হার কমে। প্রসূতিকালীন সেবা দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা প্রসূতি মাকে ও তাঁর পরিবারকে গর্ভকালীন বিপদচিহ্নগুলো সম্পর্কে সচেতন করে থাকেন । এসময় পরিবারের সদস্যদেরকে সম্ভব্য বিপদ সম্পর্কে জানতে হবে এবং করণীয় সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এ সময় প্রসূতি পরিবাগুলোর নিরাপদ ডেলিভারি নিশ্চিতের জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়। এ জন্য পর্যাপ্ত নগদ টাকার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সমস্যা হলে কোন জায়গা থেকে সেবা নেওয়া হবে তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হবে। এ সময় প্রসূতি সাধারনত যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হয় সেগুলো হলো প্রসব–পূর্ববর্তী রক্তক্ষরণ,খিঁচুনি,চোখে ঝাপসা দেখা অথবা তীব্র মাথাব্যথা,তীব্র জ্বর,বিলম্বিত প্রসব অর্থাৎ ১২ ঘণ্টার বেশি প্রসবব্যথা ও প্রসবের সময় বাচ্চার মাথা ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ বের হয়ে আসা। এ চিহ্নগুলো দেখা গেলে যত দ্রুত সম্ভব প্রসূতিকে আশপাশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। প্রসবের পর মা ও শিশুর নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা, উপযুক্ত উপদেশ এবং ব্যবস্থাপনা দেওয়াকে প্রসব পরবর্তী সেবা বলে। প্রসবের পরে একজন প্রসূতি মা স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। কারণ, প্রসবের পর মায়ের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সাধারণত ৬ সপ্তাহ সময় লাগে। এই সময়কালকে পিউরপেরিয়াম (Pureperium) বলে। পিউরপেরিয়াম সময়ে মায়ের প্রসবোত্তর স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হয়। প্রসবোত্তর স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার মাধ্যমে প্রসূতিকালীন সময়ের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা,মায়ের সুস্থ স্বাস্থ্য বজায় রাখা, শিশু মায়ের স্তন্যপান করছে কি না তা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও পরিবারকে শিশুর যত্নের উপদেশ দেওয়াসহ শিশুকে টিকাদানের পরামর্শ দেওয়া হয়। সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশুর শরীর দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এ সময় সঠিক যত্ন নিতে হয়। কিছু নিয়ম মেনে চললে এসব জটিলতা এড়ানো সম্ভব। প্রসবের পর সঠিক যত্ন নিলে মায়ের শরীর যেমন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়, তেমনি শিশু সুস্থ থাকে ও সবল হয়ে ওঠে। নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, প্রচার, পরামর্শ, স্বল্পমূল্য ও বিনামূল্যে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার কারণেই নারীরা এখন প্রজনন স্বাস্থ্যে সকলকে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছেন। গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই একজন নারীর আশেপাশের পরিচিত লোকজন বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটা করবে না, ওইটা খাবে না , এটা ব্যবহার করলে সন্তানের জন্য খুব খারাপ এরকম আরও কত যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়! এগুলো অধিকাংশই কুসংস্কার। আমাদের দেশের গ্রমাঞ্জলে সাধারণত যে সকল কুসংস্কার রয়েছে সেগুলো হলো Flu vaccine নেয়া যাবে না। অনেকেই ভয় পান এটা ভেবে যে এর কারণে গর্ভে থাকা শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হবে।কেউ কেউ মনে করেন হয়ত তার শিশুর কিছু হবে না কিন্তু তিনি Flu আক্রান্ত হবেন। প্রকৃতপক্ষে Pregnancy তে নারীর immune system এ কিছু পরিবর্তন আসে। এসময় তাই একজন গর্ভবতী নারীর Flu হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ অবস্থায় Flu vaccination মা এবং মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর জন্য খুবই জরুরি। ২ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যতোটুকু খাদ্য গ্রহণ করে তত পরিমাণ খাদ্য একজন গর্ভবতী খাবেন এমন পরামর্শও অনেকে দেন। যদি একজন গর্ভবতী নারীর ওজন গর্ভধারণের আগে স্বাভাবিক থেকে থাকে তাহলে শিশুর সঠিক বৃদ্ধির জন্য তাকে আগের তুলনায় প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসকদের মতে একজন নারীর গর্ভাবস্থার আগে যদি অতিরিক্ত ওজন না হয়ে থাকে তাহলে গর্ভাবস্থায় তার ওজন ২৫ থেকে ৩৫ পাউন্ড বৃদ্ধি পাওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু এর বেশি নয়। কারণ শিশুর জন্মের পর মায়ের অতিরিক্ত ওজন কমাতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। যদি ওজন ৫০পাউন্ডের বেশি বৃদ্ধি পায় তাহলে সেক্ষেত্রে শিশু জন্মের সময় কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। আর জন্মের সময় যেসব শিশু অতিরিক্ত ওজনের হয়ে থাকে তাদের বড় হওয়ার পরে মোটা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ সরকার মিডওয়াইফের মাধ্যমে নিরাপদ মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি এবং জরুরি প্রসব সেবাসহ প্রসবকালীন জটিলতায় সঠিক রেফারেল সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য মিডওয়াইফারি বা ধাত্রী সেবা মাতৃমৃত্যু হার কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে মোট পেশাদার ধাত্রী আছেন ৪ হাজার ৩৯৬ জন এবং সহযোগী ধাত্রী আছেন ৭ হাজার ২০২ জন। অর্থাৎ প্রতি ১০ হাজার জনে পেশাদার মিডওয়াইফ আছেন ০.৩ জন। সারা দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে রেজিস্টার্ড মিডওয়াইফগণ বিগত ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রায় কমবেশি ২ লাখ ৬১ হাজার টি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন কম বেশি ১৭ লাখ ৭৬ হাজার জন গর্ভবতী মাকে গর্ভকালীন সেবা এবং দেড় লাখেরও বেশি জন সেবা গ্রহীতাকে পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান করেছে। (তথ্য সূত্র: ডিএইচআইএস-২,২০২৩)। যা দেশের মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশল, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশে উন্নীত করা এবং দক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসবের হার ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করা। পাশাপাশি মাতৃমৃত্যুর হার এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে ৪ বার গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার শতভাগে উন্নীত করা। বর্তমান সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রসূতি মায়ের দক্ষ সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে জীবিত জন্মে ৭০- এর নিচে এবং নবজাত মৃত্যুহার প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ১২-তে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচি (২০১৭-২২) বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং এরই মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র (২০১৯-৩০) অনুমোদিত হয়েছে এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ২০০৯ সালে নেয়া উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে নারীর গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর জরুরি সেবা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে মজবুত ও টেকসই করতে ১০৭টি মেডিকেল কলেজ, পাঁচ হাজার ১৮২টি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, প্রায় ১০ হাজার ৪০০ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৪৬টি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতাল, ৪২৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাঁচ লক্ষাধিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী কর্মী দেশের সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি জাতিসংঘের ডব্লিউএইচও, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা এনজিও, পেশাজীবী সংগঠন ও কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যৌথভাবে কিছু কর্মসূচি চালু করেছে। নিরাপদ মাতৃত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলাসহ প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমসহ সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এ সকল উদ্যোগের মাধ্যমে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। লেখক: তথ্য সহকারী, পিআইডি, ঢাকা। পিআইডি ফিচার |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |