পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পলিথিন চরম হুমকি
মো. জিল্লুর রহমান
|
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।জানা যায়, ১৯৬৮ সালের ২০ মে সুইডেন সরকার পরিবেশ সুরক্ষার জন্য জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৪ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ এজুনকে জাতিসংঘ 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' হিসেবে ঘোষণা দেয়। পরিবেশ সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার যেমন শেষ নেই, তেমনিভাবে প্রচার-প্রচারণা ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পলিথিন চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ কারণে প্রায় দুই দশক আগে আমাদের দেশের সরকার ১ জানুয়ারি ২০০২ ঢাকা শহরে এবং ১ মার্চ ২০০২ থেকে সারা দেশে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন কিছুদিন পাটের (চটের) ও কাগজের ব্যাগের ব্যবহার সাময়িক সময়ের জন্য লক্ষ্য করা গেলেও প্রচার-প্রচারণা এবং মানুষের অসচেতনতার অভাবে আবার পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, খালি হাতে বাজারে গিয়ে ৮-১০টি রঙিন পলিথিন ব্যাগ ছাড়া ঘরে ফেরা অসম্ভব এবং অকল্পনীয়। মূলত বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এর মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ একশ বছরেও পচে না ও মাটির সঙ্গে মিশে না, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি, সকল জীববৈচিত্র্য ও জলজ প্রাণী। পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি, যা পরিবেশ সুরক্ষার জন্য মোটেই উপযোগী নয়। তাই নিজেদের স্বার্থে এবং পরিবেশের সুরক্ষায় ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারণ এগুলো অতিপ্রয়োজনীয় পানি এবং মাটি মারাত্মকভাবে দূষণ করছে। বিভিন্নভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সারের সৃষ্টি করছে। এর বিকল্প হিসেবে পাটের সোনালি ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পলিথিনের মধ্য থেকে বিষফেনোল নামক বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিন মাটির সঙ্গে মেশে না, বরং মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকে পড়ে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলে। পলিথিন পোড়ালে তাতে বাষুদূষণ ঘটে। বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই ফলশ্রুতিতে, ২০০২ সালে দেশে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন দামে সস্তা কিন্তু এর বিকল্প পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন হওয়া সত্বেও শুধু সরকারি উদ্যোগ ও উদাসীনতার অভাবে পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্জ্য পদার্থ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত পলিথিন ব্যাগ শুধু খাদ্যসামগ্রীকেই বিষাক্ত করছে তা নয়, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শহরগুলোতে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। কেননা শহরের নর্দমা ও বর্জ্য নির্গমনের পথগুলো পলিথিন দ্বারা পূর্ণ। পলিথিনের কারণে পানি আটকে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। ব্যবহৃত পলিথিন গলিয়ে আবার ব্যবহার করায় এতে রয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল, যা থেকে ক্যান্সার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসার মতে, শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। একই সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান, যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। পরিবেশ দূষণের দায়ে কল-কারখানাকে জরিমানা কিংবা নদ-নদী ও জলাশয় দূষণ বা দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো হলেও পলিথিনের ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ তেমন নেই বললেই চলে। এ কারণে সর্বত্র নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদিও এ অপরাধ বন্ধে সচেতনতারই বেশি দরকার, তবুও আইনের প্রয়োগও বাড়াতে হবে। না হলে এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। এ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবাধে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। এছাড়া বর্তমানে পলিথিনের কাঁচামাল দিয়ে এক ধরনের টিস্যু পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদনকারীরা বলছে এটা ‘পরিবেশ বান্ধব’। কিন্তু বুয়েটের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, পলিথিনের মতই টিস্যু পলিথিন পরিবেশের জন্য ‘মারাত্মক ক্ষতিকর’। অথচ, পলিথিনের বিকল্প হিসাবে নতুন উদ্ভাবিত পরিবেশ বান্ধব পাটের সোনালি ব্যাগ সহজেই ব্যবহার করা যায়, দরকার শুধু সরকারি উদ্যোগ ও সদ্বিচ্ছা। প্রায় ২৫ বছর আগে করা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ২০০২ সালে সংশোধনী এনে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। সরকার এ ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬(ক) ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রি উৎপাদন, আমদানী বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে। শুধু প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলেই পলিথিনের ব্যবহার রোধ করা সম্ভব। এজন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরকে অধিক সতর্ক হতে হবে এবং পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭২টি দেশ পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সব দেশই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে শাস্তির বিধান করলেও ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। কেনিয়া সরকার কারো হাতে পলিথিন দেখলেই গ্রেপ্তার করার বিধান জারি করেছিল। আয়ারল্যান্ড সরকার পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে বাড়তি কর আরোপ করেছে। পর্তুগাল, স্পেনও এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। উগান্ডার বিমানবন্দরে পলিথিনসহ কাউকে পেলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছিল, কিন্তু পলিথিনের বিকল্প জানা না থাকায় তা বেশি দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি। পানিতে বর্জ্যের ৭০ শতাংশ পলিথিন ব্যাগ। এ কারণে ২০২০ সাল থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার আইন করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। ইউরোপেই বছরে ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এসব দেশ পলিথিন ব্যাগ বন্ধে আইন করলেও বিকল্প জানা না থাকায় এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছে না। বাংলাদেশেও ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও সর্বত্র এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতি মাসে চার কোটি ১০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগ তৈরি করে সাড়া ফেলার পর এখন বৃহৎ পরিসরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারলে এটি দিয়েই দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিশ্ববাজার দখল করা সম্ভব। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ বিশ্বজুড়ে যখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন পাটের এই প্রাকৃতিক পলিব্যাগ বিশ্বের পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়তা করবে। দেশীয় চেইনশপগুলো এই সোনালি ব্যাগ ব্যবহার করতে আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। এজন্য দরকার সরকারি উদ্যোগ ও সুষ্ঠ পরিকল্পনা। বর্তমানে বছরে ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল পলিব্যাগের বৈশ্বিক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পাটের সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করতে পারলে তা যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করবে, তেমনি রক্ষা পাবে আমাদের পলিথিন ব্যাগে কলুষিত পরিবেশ। এখন কাগজ ও পাটের ব্যাগের ব্যবহারই আমাদের পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে পারে। পাটের সোনালি ব্যাগ পরিবেশবান্ধব ও দামে সাশ্রয়ী। পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাত বন্ধে সরকারের ব্যাপক নজরদারিসহ গণমাধ্যম গুলোতে (রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম) ব্যাপক প্রচারণা দরকার। পাশাপাশি পাটের ও কাগজের ব্যাগের ইতিবাচক দিক, সাশ্রয়ী দাম ও সহজে প্রাপ্তির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়া দরকার। লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট ডেল্টা টাইমস্/মো. জিল্লুর রহমান/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |