দেশের ওপর যেকোন নিষেধাজ্ঞা জাতির জন্য লজ্জার
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() . প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। সবারই কমবেশি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আছে। তাই আমেরিকাকে গুরুত্ব না দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সুতরাং যারাই রাজনীতি করেন এবং নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবেন তারাই এটাকে গুরুত্ব দেবেন। নতুন মার্কিন ভিসা নীতি এক ধরনের সতর্কতা। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আরও নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন ভিসা নীতির কারণে বাংলাদেশ একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করে ফেলবে-এমনটা মনে করা ঠিক নয়। তবে এই ভিসা নীতির একটি সর্বব্যাপী প্রভাব আছে। বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট বলছে, পরাশক্তিরা এখানে কাজ করছে। সংঘাতময় একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাইজেরিয়ায়ও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এখানে বিচার বিভাগকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কিন্ত বাংলাদেশের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমদানির চেয়ে রপ্তানির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রেমিট্যান্সের একটা বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র এবং রপ্তানির জন্য বড় একটি জায়গা। মার্কিন নতুন ভিসা নীতি কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা, কারণ একটা সময় ছিল তখন মানুষ আমেরিকা নিয়ে তেমন ভাবত না বা যাতায়াত করত না। বলতে পারেন সুযোগ সুবিধাও তেমন ছিল না। কিন্ত বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের জনগণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখন দেশ ও মানুষের জন্য এক অপার সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সব পেশার মানুষের আনাগোনা হয় আমেরিকায়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য এক স্বপ্নের জায়গা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে নতুন এবং বিরল ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে তা দেশ ও জাতির জন্য, সতর্কতামূলক, হুঁশিয়ারিমূলক এবং রাষ্ট্রের জন্য অসম্মানজনক। এই গভীর সত্য উপলব্ধি করতে মার্কিন ভিসা নীতি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে-বাংলাদেশের নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্তকারী ব্যক্তি ও তার পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের বিরুদ্ধে ভিসায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। তার সাথে সাথে আমেরিকাগামী ছাত্র ছাত্রী ও সাধারণ মানুষের ওপরও তার প্রভাব বিস্তার করবে এটা স্বাভাবিক। এই বিষয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না গণতন্ত্রকে কারা ধ্বংস করেছে, কারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানকে হাতের খেলনা হিসেবে ব্যবহার করেছে। প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশের অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কারা ব্যাহত করছে তাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অ্যান্টনি ব্লিনকেনের ঘোষণায় খোলাসা করেই বলা হয়েছে-বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে কেবলমাত্র বাংলাদেশের জন্য ওই ভিসা নীতি প্রণয়ন করা হলো। এই নীতির অধীনে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল বা বাধা প্রদানের জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্য তথা জীবনসঙ্গী, ছেলে বা মেয়ের ভিসার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ হবে। কূটনৈতিক ইতিহাসের দিকে থাকালে দেখা যায়, কোনো দেশ কর্তৃক তার আইনগত অধিকার রক্ষা বা বিপদগামী দেশকে সংশোধনের উদ্দেশ্যে আইনগতভাবে প্রতিপক্ষের অবন্ধুসুলভ বক্তব্য ও ব্যবস্থার জবাবে এমনকী প্রতিপক্ষের ক্ষতিকর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ বৈধ বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র তা পুনরুদ্ধারের জন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ না করায়-নতুন ভিসা নীতি আরোপ করা হয়েছে। নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এর মধ্যে বর্তমান বা প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী দলের সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করে। নতুন ভিসা নীতিটি সেই প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশি জনগণকে সমর্থন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে তারা তাদের পছন্দের নেতা নির্বাচন করতে পারে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার জন্য, জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা কে নিষিদ্ধ করার জন্য, কাউকে আমরা অভিযুক্ত বা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা বা বিচারের মুখোমুখি করার প্রয়োজন বোধ করিনি। আর জনগণের সম্মতি প্রদানের জন্য কোনো ডিজাইনও প্রস্তুত করতে পারিনি। বিদেশিরা দেশকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, এটাকে সিগন্যাল বলে চিহ্নিত করেছে। অথচ আমরা তার তাৎপর্য উপলব্ধি করার প্রয়োজনও বোধ করছি না। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন,এটা বেশ কঠোর একটা সিদ্ধান্ত এবং এখানে একটা খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র প্রসারের এজেন্ডার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া হচ্ছে। তার কথায়, বাইডেন প্রশাসন একটা মূল্যবোধ-ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা জোরালোভাবে প্রয়োগ করছে। বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছিল কিন্তু তখন যুক্তরাষ্ট্র এ রকম কোনো ভূমিকাই নেয়নি। কারণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি মূল্যবোধভিত্তিক ছিল না। কিন্তু বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি মূল্যবোধভিত্তিক এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে তারা অগ্রাধিকারের তালিকায় এক নম্বরে রেখেছে। নতুন ভিসা নীতিকে এ প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করাটাই সবচেয়ে সঠিক হবে বলে গণ্য করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। বাইডেন সরকার যদি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে মনে করতো তাহলে নিশ্চয়ই ডেমোক্রেসি সামিটে বাংলাদেশ আমন্ত্রিত হতো। এখন দেখা যাচ্ছে যে, কূটনৈতিক পন্থার বাইরে গিয়ে তারা প্রয়োজনে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতেও ইচ্ছুক এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং অধিকার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও প্রস্তুত। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ঘাটতিকে মোকাবিলা করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল করার প্রশ্নটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে উত্থাপিত হচ্ছে।এসব সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য চরম লজ্জাজনক। ভিসা নীতির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের অনুসৃত নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা। সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তো আছেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মার্কিন ভিসা নীতির অবলম্বনে সম্ভাব্য ফলাফলের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জটিল রাজনৈতিক হিসাব বিবেচনা করতে হয়। সুতরাং দেশ ও জাতির স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে ততই সবার জন্য মঙ্গল হবে। বাংলাদেশের চরম দারিদ্র এবং নিচের দিকের লোক একসময় ৫০ বা ৭০ শতাংশ ছিল। সেটা কমে গেছে, কিন্তু সেটা কমলেও যেকোনো বিপদ হলে যে সেটা বেড়ে যায়, সেটা কভিডের সময়ে আমরা দেখেছি, ৪০ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার বিআইডিএসের গবেষণা বলছে কমেছে কিন্তু এটা ১৮-২০ শতাংশ হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। আমরা তো দারিদ্র্যশূন্য, ক্ষুধাশূন্য বাংলাদেশ চাই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা যেটা বলা হয়, সেটি যদি চাই, তাহলে আমাদের সে সংস্কারগুলো করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা আমাদের এ ৫১ বছরের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, কিন্তু বিরতিহীনভাবে ক্রমাগত বৈষম্য বেড়েছে। শুরুতে যে আয়বৈষম্য ছিল, এখন তার চেয়ে তা অনেক বেড়েছে। এ বৈষম্য বেড়েছে ন্যায়পরায়ণতা লঙ্ঘন করে। এমন হতে পারে যে একজন লোক বিল গেটসের মতো খুব বেশি গুণী, যে হয়তো একটি নতুন থিউরি আবিষ্কার করেছে, কম্পিউটার সফটওয়্যার আবিষ্কার করেছে। সে তার আবিষ্কারের জন্য অনেক টাকা আয় করেছে, আরেকজন লোক অত গুণী না, এত পরিশ্রমী না। সুতরাং আয় করতে পারেনি। সে রকম পরিশ্রমের ভিত্তিতে ধনী হলেও একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখানে লুটপাট, সিন্ডিকেট এবং বিদেশে অর্থ পাচার করে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে অল্প কিছু লোক ধনী হচ্ছে। এদের পুঁজির একটি বড় অংশ দেশের ভেতরে কোনো উৎপাদনশীল কাজে লাগছে না। তাহলে এই যে অনুৎপাদনশীল ধনী এবং তারা যে রকেটের গতিতে ধনী হচ্ছে আর উৎপাদনশীল দরিদ্র শ্রেণী, তারা যে শামুকের গতিতে আয় বাড়াচ্ছে। এটাই হলো বাংলাদেশের উন্নয়নের সীমাবদ্ধতার মূল প্রতিচ্ছবি। সুতরাং আমাদের মনে রাখতেই হবে, গরিব ও ধনীদের আয়ের উন্নতি যেন সাংঘর্ষিক না হয়, বৈষম্য তৈরির সহায়ক না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। একটা বিষয় হচ্ছে প্রবৃদ্ধিটা কি বাইরের পরিবেশ, প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে হয়েছে? এ প্রবৃদ্ধি কি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়েছে? এর ফলে সামাজিক বৈষম্য, হিংসা বা দ্বন্দ্ব কি কমেছে? সাধারণ মানুষের জীবনে সুখ বা সন্তুষ্টি কি বেড়েছে? নাকি এসব হচ্ছে না অথবা হলেও তা বেশির ভাগ উপরের ১০ শতাংশ এলিট বা ক্ষমতাবানদের জন্যই হচ্ছে? দেহের আকার বাড়লেই স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে-এটা যেমন বলা যায় না তেমনি গড় মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি হলেই উন্নয়ন হচ্ছে এটা বলা যায় না। এর সঙ্গে আরো কয়েকটি আদর্শ মাপকাঠি বিচার করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।দেশের বয়স ৫১ বছর অতিক্রম করেছে। আজ পর্যন্ত আমাদের রাজনীতিকেরা বার বার ক্ষমতায় এসেও একটা স্থায়ী নির্বাচন পদ্ধতি আবিস্কার করতে পারলনা এর চাইতে বড় লজ্জার বিষয় কি হতে পারে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |