মিয়ামি পুনর্মিলন ভেঙেছে সীমান্ত-দিগন্ত-প্রশান্ত
রহমান মৃধা
|
বড় বড় কয়েকটি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে কিউবা। কিউবার দক্ষিণে জ্যামাইকা ও দক্ষিণ-পূর্বে হাইতি। আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হলে আটলান্টিক মহাসাগর। পশ্চিমে মেক্সিকো উপসাগর এবং আরও পশ্চিমে বিশাল মেক্সিকো। বিশ্বমঞ্চে কিউবা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দেশ নামেই পরিচিত। তিনি প্রচার করেন সমাজতন্ত্রের সাম্যবাদ। বেশিরভাগ জনগণ তার মতবাদকে স্বাগত জানান। পুঁজিবাদের মোড়ল আমেরিকার ঠিক পেটের ভেতরে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ বেড়ে উঠবে, এটা কল্পনা করা যায় না। ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও তার মতবাদকে যেসব কিউবান মেনে নিতে পারেননি, তারা ছেড়েছেন কিউবা, ছেড়েছেন প্রিয়জন, নিয়েছে আশ্রয় ভিন্নদেশে, নতুন জীবনের আশায়। হাভানার দুই নতুন প্রজন্ম আলেক্স ও আনালোই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন, একে অপরের প্রেমে আসক্ত। তাদের স্বপ্ন ফ্লোরিডাতে যেতে হবে নতুন জীবনের সন্ধানে, যেখানে খুঁজে পাবেন স্বাধীনতা ও মানবতার মৌলিক অধিকার। কিন্তু ফ্লোরিডাতে তো ঢোকা কঠিন? কী করা? পরিকল্পনা হলো আনালোইকে প্রথমে সুইডেনে পাঠানোর। এক বছর টাকা জমিয়ে আনালোইকে সুইডেনে পাঠানো হয়েছে দালালের মাধ্যমে। একমাস হতে চলেছে আনালোই সুইডেনে। এরই মধ্যে আনালোই জানতে পেরেছেন, সুইডেনে তার পারমিশন হবে না, বসবাস করতে পারবেন না, তাই মন খারাপ। আলেক্সকে ছেড়ে একাকী জীবনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এসেছেন ডাক্তারের কাছে। ঠিক একই সময় সহধর্মিণী মারিয়াও এসেছেন। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেই ভাষাগত সমস্যার কারণে ঠিকমতো তার সমস্যা বোঝাতে পারছেন না। তিনি ইংরেজি বা সুইডিস জানেন না, স্প্যানিশ ভাষাতে চেষ্টা করছেন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝতে পারছেন না। এমতাবস্থায় ডাক্তার মারিয়াকে দোভাষী হিসেবে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেন। আনালোই মারিয়ার সাহায্যে আপ্লুত হন এবং স্বল্প সময়ের পরিচয়ে তাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়। সুইডেনে থাকার ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে মারিয়া তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এবং তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আনা হ্যানসনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আনালোই দেখতে অনেকটা হ্যানসনের মতো, চুল এবং চোখের রং শুধু ভিন্ন। হ্যানসন আনালোইয়ের সব জানতে পেরে তার পাসপোর্ট দিয়ে বলল, ‘তুমি দেখতে যখন আমার মতো, তাই পুলিশের কন্ট্রোল ছাড়াই সুইডেন থেকে চলে যেতে পারবে।’ ‘তাছাড়া সুইডেন থেকে বের হতে সচরাচর পুলিশের চেক হয় না। তোমার চুলের রং কালো, তাই লম্বা চুলকে কালার করলে এবং চোখে ব্লু-রংয়ের লেন্স লাগালে কোনো অসুবিধা হবে না।’ পরিকল্পনা অনুযায়ী আনালোই স্টকহোম থেকে সরাসরি মিয়ামিতে (মিয়ামি, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর) যাবে সুইডিস হিসেবে। আমি সেদিন অবাক হয়েছিলাম মারিয়া এবং তার প্রিয় বান্ধবী হ্যানসনের মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ দেখে। মনে হচ্ছিল সেদিন ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ আনালোই মারিয়ার বান্ধবীর পাসপোর্টে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রওয়ানা দিলো স্টকহোম আরলান্ডা টু মিয়ামি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ফ্লোরিডাতে। আনালোই মিয়ামি বিমানবন্দরে নাসতেই বাথরুমে ঢুকে সুইডিশ পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে কাঁচি দিয়ে চুল কেটে ছোট করেন, চোখের লেন্স ফেলে দিয়ে তার কিউবার পাসপোর্ট এবং নিজের চেহারায় ফিরে ইমিগ্রেশনে হাজির কিউবান হিসেবে। পুলিশের সন্দেহ থাকার কথা নয়, কারণ, পারফেক্ট স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা থেকে শুরু করে সবকিছু ঠিকঠাক। পুলিশের প্রশ্ন কীভাবে কোথা থেকে এবং কোনো এয়ারলাইন্সে তিনি এলেন? আনালোই পুলিশকে জানিয়েছেন, দালালের মাধ্যমে এবং তাদের সহায়তায় তিনি এসেছেন। ১৯৯৬ সালের কথা, নিয়ম অনুযায়ী যদি কোনো কিউবান আমেরিকার বর্ডারে একবার ঢোকেন, তবে তাকে ফেরত দেবার নিয়ম নেই, বিধায় আনালোই ঢুকে গেলেন সেদিন ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকাতে। খবর পৌঁছে গেলো হাভানাতে, আলেক্স খুশি যে তার বান্ধবী ঢুকেছেন আমেরিকাতে। এখন আলেক্সের পালা। আনালোইয়ের আমেরিকান গ্রিন কার্ড রেডি হতে সময় লাগবে কয়েক বছর। আর দেরি নয়, রিস্ক নিতে হবে। ভালোবাসার পুনর্মিলনের জন্য জীবন দিতে বাধা নেই আলেক্সের। রাতের আঁধারে আলেক্স প্ল্যান করেছে ছোট্ট নৌকা করে সাগর (হাভানা থেকে কি-ওয়েস্টের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার হবে) পাড়ি দেবে। আটলান্টিক এবং গালফ অব মেক্সিকোর সমন্বয়ে এই সাগর, যার মধ্যে রয়েছে হাঙ্গর, তারপর রয়েছে সাগরে বর্ডার গার্ড পুলিশ। সবকিছু জেনেশুনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের আঁধারে ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস করে এই প্রেমিক রওনা দিলো সেদিন তার প্রেমিকার সান্নিধ্য পেতে, যে বসে আছে পথ চেয়ে কি-ওয়েস্টের সাগরপারে। দীর্ঘ তিন দিন তিন রাত ছোট্ট নৌকায় করে পথ চলতে তিনি দেখেছিলেন ক্ষুধার্ত হাঙ্গর, ভয়কে জয় করেছিলেন শুধু ভালোবাসা দিয়ে এবং শেষে ঢুকেছিলেন প্রথমে কি-ওয়েস্টে এবং পরে তার প্রিয় বান্ধবী আনালোইয়ের মনের মধ্যে। কিছু ঝামেলা হয়েছিল ইমিগ্রেশনের শুরুতে, পরে সব ঠিকঠাকমতো হয়ে যায় এবং দুজন তাঁদের ভালোবাসার জীবন খুঁজে পায় একে ওপরের মাঝে। আমাদের সঙ্গে আলেক্স এবং আনালোইয়ের অতীতের স্মৃতি থেকে যোগাযোগ এখনও রয়েছে। আলেক্স ও আনালোইয়ের আমেরিকাতে পারমিশনের এক বছর পরে (১৯৯৮) গিয়েছিলাম বেড়াতে তাদের বাড়িতে। দুজনই প্রকৌশলী, সুন্দর জীবনযাপন করছেন তারা আমেরিকাতে। আমাদের পেয়ে তারা হয়েছে দিশাহারা, মনে হচ্ছে ভালোবাসার ঋণ শোধ করতে এমনটি আয়োজন। এমন কৃতজ্ঞতাবোধ অনুভব করিনি এর আগে কখনো। কারণ, উপকার তো নিজের আপনদেরও করেছি, কিন্তু তারা কেন অকৃতজ্ঞ হলো? ভাবনায় এসেছিল ক্ষণিকের তরে সেদিন! তারপর অনেকবার আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, শহরে বেড়িয়েছি, কাজের সুবাদে, ছেলে-মেয়ের টেনিসের সুবাদে; ছোট বোন জলি থাকে লস এঞ্জেলসে, সেই সুবাদে। তবে ছেলে-মেয়ের টেনিসের সুবাদে মিয়ামি ভ্রমণ করেছি বহুবার। যেমন একবার মিয়ামি ট্যুর শেষে আমরা সবাই গিয়েছিলাম বড় ভাই মান্নান মৃধার বন্ধু ফিরোজ ভাই ও সালমা ভাবির বাড়ি টাম্পাতে। টাম্পা মিয়ামি থেকে গাড়িতে চার ঘণ্টার পথ। তারা থাকেন টাম্পার ফোর্ট মায়ারে। ওয়েস্ট পাল্মবিস থেকে সকাল সকালে গাড়িতে করে রওনা দিয়েছি, পথে হঠাৎ দেখি রাস্তার দুই ধারে লেক বয়ে চলেছে এবং শত শত এলিগেটর বা কুমির পাড়ের ওপরে মনের আনন্দে সূর্যের তাপে বিশ্রামে মগ্ন। কুমিরের নাম শুনেছি এবং দেখেছি, সি-ওয়ার্ল্ডে বা বিশ্বের বিভিন্ন চিড়িয়াখানাতে ঠিকই কিন্তু এভাবে রাস্তার দুই ধারে শত শত কুমির এ জীবনে প্রথম দেখলাম। পথে হরেক রকম মজার মজার পশুপক্ষী দেখতে দেখতে চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে এবং আমরা হাজির টাম্পাতে। লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ডেল্টা টাইমস্/রহমান মৃধা/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |