সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অগ্নিকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না
মো. জিল্লুর রহমান:
|
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের বহুতল ভবনের ভয়াবহ অগ্রিকান্ডে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১১ জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় আশঙ্কাজনকভাবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। এছাড়া উক্ত ঘটনায় ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসকরা বলছেন, মারা যাওয়া ৪৬ জনের বেশির ভাগের শরীরে পোড়ার কোন দাগ ছিল না। কারও সামান্য থাকলেও তা মৃত্যু ঘটানোর মতো পর্যাপ্ত কারণ নয়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ মৃত্যুর কারণ ‘কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং’, সহজ ভাষায় যাকে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া বলা যায়। কোথাও আগুন লাগার পর অক্সিজেনের অভাব তৈরি হলে কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। এ অগ্রিকান্ডের খবর দেশের সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম বিবিসি, সিএনএন, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, এএফপি, এপি এবং আল-জাজিরার মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। আসলে এগুলোর কোনটাই নিছক দুর্ঘটনাজনিত কোন মৃত্যু নয়, এগুলো এক একটা হত্যাকান্ড। এখন তদন্ত কমিটি হবে, কার কি অবহেলা শুধু সেটাই জানা যাবে, কোন প্রতিকার পাওয়া যাবে না। এখন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলছে, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো অজানা কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আগুনের ঝুঁকি ও অনুমোদন না থাকার পরও ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ চলছিল বছরের পর বছর ধরে। ভবনটিতে যে আগুনের ঝুঁকি ছিল, তা জানত সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো। তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বা নেয়নি। ভবন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি গায়ে মাখেনি। মানুষের মৃত্যুর পর এসব গাফিলতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। খবরে প্রকাশ একজন শিক্ষার্থী তার বাবাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আব্বু, আগুন! আমাদের বাঁচান...।’ সেই শেষ কথা। পরে মেয়ের মুঠোফোনে শতবার ফোন করেন বাবা। তবে ফোন আর কেউ ধরেনি। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে বাবা চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি...মাগো...।’ দুজন বুয়েটে পড়ুয়া শিক্ষার্থী মর্মান্তিক এ অগ্নিকাণ্ডের শিকার। তাদের বাবা, মা বা এরকম অনেকেই প্রিয়জনকে হারিয়ে বুকফাটা আর্দনাদ করছে, আকাশ বাতাস ভারী করে তুলছে। তাদের কারও শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই। শোকের পাথরে তারা নিথর এবং কোন স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও মনকে শান্তনা দেওয়া কঠিন। সেক্ষেত্রে এতগুলো তাজাপ্রাণ অকালে ঝড়ে পড়া কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। অগ্নিকাণ্ডের অনেক কারণ আছে। অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণসমূহের মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও জরুরি নির্গমন বিষয়ে জ্ঞান না থাকা, দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থের অনুমোদনহীন গুদামজাতকরণ। এছাড়া শহর ও গ্রামে রান্নার পর আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে না দিলে, বাতাসে উড়ে গিয়ে সেই আগুন বাড়ির বেড়ায় লাগতে পারে; ছাইয়ের আগুন বাতাসে উড়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে; চুলার উপর খড়ি শুকাতে দিলে খড়িতে আগুন লেগে যেতে পারে, সে আগুন বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে পারে; সিগারেট, বিড়ি ও হুঁকার আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে বলে বিভিন্ন তদন্তে প্রমাণিত। প্রাথমিকভাবে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বেইলি রোডের অগ্রিকান্ডের কারণ বলে জানা যায়। বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের কারণে সিড়ির গ্যাস সিলিন্ডার হয়তো অনেকের চোখে পড়ছে। অথচ বাংলাদেশের অলি-গলি এমনকি চলাচলের রাস্তায় অনুমোদনহীন যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। যার ফলে সাধারণ মানুষ চলাচলের সময় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা আতঙ্কে তটস্থ থাকে। যারা গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করে তাদের সামান্য গ্যাস লিকেজ হলে কি করবে সেই ন্যুনতম জ্ঞানটুকুও নেই। তবু এরা দেদারসে বিক্রি করছে, যেন দেখার কেউ নেই কিংবা কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করছে। অবিলম্বে এধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা রোধে সরকারি নীতিমালা, কঠোর নজরদারি ও তার প্রয়োগ জরুরি। অন্যথায় এ ধরনের প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, বিগত ১০ বছরে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১০ সালে, পুরান ঢাকার নিমতলীতে। এতে ১২৪ জন নিহত হন। এর পরের বছর সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ১১১ জন। আর ২০১৬ সালে টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৪১ জন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, ২০১০ সালে সারা দেশে ১৪ হাজার ৬৮২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৭১ জন নিহত ও ৭৯৪ জন আহত হন। ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৮১৫টি দুর্ঘটনায় ৩৬৫ জন নিহত ও ১ হাজার ৪৭৯ জন আহত হন। ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যার, আশুলিয়ায় ২৯ জন নিহত হয়। ২০১৮ সালের ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ৭ হাজার ৮২৫টি অগ্নিকাণ্ডই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। চুলার আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ৩ হাজার ৪৪৯টি, আর সিগারেটের আগুন থেকে ৩ হাজার ১০৮টি। ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে এবং সেদিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ২২৬টি দোকান পুড়ে গেছে। মার্কেটের মালিক সমিতি বলছে, আগুনে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ২০১০ সালের জুনে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রাসায়নিকের কারখানায় আগুন ধরে ১২৪ জন নিহত হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেখানে কেমিক্যালের গোডাউন থাকায় আগুন বেপরোয়া হয়ে ওঠেছিল। এ অগ্নিকাণ্ডে ৭২ জন নিহত হন এবং আহত হন অনেকেই। এছাড়াও প্রায়ই কেমিক্যালের গোডাউনগুলোতে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে। নিমতলীর ঘটনার পর থেকেই পুরান ঢাকার রাসায়নিক কেমিক্যাল গোডাউন ঢাকার আশেপাশে সরিয়ে নেয়ার কথা উঠলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। এক সময় পাট ও তুলার গুদামে বেশ আগুন লাগার খবর পাওয়া যেত। এখন বেশি আগুন লাগে মার্কেট, বিপণী বিতান ও গার্মেন্টসে। তাও প্রধানত রাজধানী ও আশপাশে। এমনকি অত্যাধুনিক ও ডিজিটাল বলে দাবিদার সুপার মার্কেটেও একাধিকবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। পরে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে, বহু কথিত আধুনিক মার্কেটেও স্মোক ডিটেক্টরসহ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না; এমনকি পানিও নয়। আবার থাকলেও প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মী ছিল না। দেশে-বিদেশে বহুল প্রচারিত তাজরীন গার্মেন্টসের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। আবার নিমতলী ট্র্যাজেডির মতো ভয়াবহতাও আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনাও রয়েছে। চকবাজারেও পানির রিজার্ভসহ অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা প্রায় ছিল না বললেই চলে। একই কথা প্রযোজ্য বহুতল বিশিষ্ট বাসাবাড়ি এবং সরকারি-বেসরকারি অফিসের ক্ষেত্রেও। আসলে জরুরি অবস্থা ও ব্যবস্থার কোনো ধারণাই গড়ে ওঠেনি ভবন নির্মাণসহ অগ্নিনির্বাপণ কিংবা অন্যবিধ দুর্ঘটনা মোকাবেলায়। এ বিষয়ে কারও কোনো প্রশিক্ষণও নেই বললেই চলে। যে কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিপুল প্রাণহানিসহ সম্পদের ক্ষতি দেখে যাওয়া ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই। এ অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে অগ্নিকাণ্ড যখন কোনও জনবহুল এলাকা বা শিল্প-কারখানাতে ঘটে, তখনই আগুনের ভয়াবহতা আমাদেরকে নাড়া দেয়, কর্তৃপক্ষও নড়েচড়ে বসে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকার চকবাজারস্থ চুড়িহাট্টা, নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, মিরপুরস্থ ভাষানটেক, গুলশান-২ এর ডিএনসিসি কাঁচা বাজার ও সুপার মার্কেট, খিলগাঁও কাঁচাবাজার, মিরপুরস্থ সিটি পার্ক ভবনের অগ্নিকাণ্ড, বিশেষ করে বনানীর এফ আর টাওয়ারের ঘটনা পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে শুধুমাত্র নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭২ জন এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৮ জন মারা যায়। তবে যেভাবেই আগুনের সূত্রপাত হোক না কেন, আসলে এগুলো কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এ যেন এক একটি হত্যাকান্ড, এক একটি স্বপ্নের মৃত্যু, যা কোনক্রমেই কাম্য ও গ্রহণ করা যায় না। এক একটি অগ্নিকান্ড, এতজন মানুষের হাজারও স্বপ্নকে পুড়িয়ে শোকে পাথর হওয়ার গল্প। বলা যায় অল্প শোকে পাথর অধিক শোকে পাথর। যদি দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যেত, তবে এ ধরনের অগ্নিকান্ড বা নিরব হত্যাযজ্ঞ ঘটতো না। অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে হত্যাকান্ড ঘটলেও, অন্যরা সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি, অগ্নিকাণ্ড রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। নিয়মানুযায়ী প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে, কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট কখনও আলোর মুখ দেখে না। কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না। প্রভাবশালীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। সব কিছু অদৃশ্য শক্তির কারণে হাওয়ায় মিশে যায়, যেন কারও কোন দায় নেই। বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ গত কয়েক বছরে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবার আগুন লাগার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। আশ্বাস দেয়া হয়, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। কিন্তু দৃশ্যপটে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন ভাবেই দায় এড়াতে পারে না, কারণ এখানে তদারকি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে যথেষ্ট অবহেলা ছিল। এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর মিছিল দেখতে চাই না, আর কোন স্বপ্নের যেন অকালমৃত্যু না হয়, সে অনুযায়ী দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি চাই। লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট। ডেল্টা টাইমস/মো. জিল্লুর রহমান/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |