উত্তরবঙ্গ মানুষের সংকট ও অমীমাংসিত তিস্তা ইস্যু
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন আর নদী ব্যবস্থাপনার আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে থেকেই। কিন্তু এর সুষ্ঠু বণ্টনে চুক্তি না থাকা এবং শুষ্ক মৌসুমে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে তিস্তা বাংলাদেশে বহুমাত্রিক সংকট সৃষ্টি করেছে। ঐতিহাসিক গঙ্গাচুক্তির পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অন্য এক উচ্চতায় পর্যবসিত হয়েছিল। সেই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় মাঝেমধ্যে ছন্দপতন ঘটে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে। তবে প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিটি এখনও ঝুলে আছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা হচ্ছে; ভূরাজনীতির অন্যতম একটি বিষয় তিস্তা নদী।স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততার কথা কারও অজানা নেই। মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছিল, যুদ্ধকালীন সময়ে এক কোটিরও বেশি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল,এদের থাকা-খাওয়াসহ নানাবিধ সাহায্য করেছিল। প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বল্প সময়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছিল ভারত। তাদের এই অপরিসীম অবদানের কথা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্পর্কের ঐতিহাসিকতায় যে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দুটো দেশ সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তা বিস্ময়কর বটে। যাই হোক তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে পরস্পরে ইতিবাচক দৃষ্টিতে কাজ করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। তিস্তার জল আমাদের উভয় দেশেরই প্রয়োজন। দুঃখ জনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি এড়িয়ে গিয়ে এবার নদী ব্যবস্থাপনার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ মনে করছে এতে করে তিস্তার পানি সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হবে। কিন্তু স্থানীয় জনগণ, পানি ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় তিস্তা সমস্যা সমাধানে ভারতের নতুন এই প্রস্তাব ইতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যখন ওই আলোচনা এবং সমঝোতা চলছে তখন তিস্তায় ভারত থেকে আসা পানির ঢলে বন্যা ও ভাঙনের শিকার হয়েছে রংপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। তিস্তার পানি নিয়ে উত্তরের জনপদের মানুষের দুর্ভোগ বহুমাত্রিক।বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মানুষ বলছেন, দেশটির তিস্তা নদী এখন এক মৌসুমী নদীতে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নদী একেবারে শুকিয়ে যায়। আর বর্ষাকালে পানি উপচে পড়ে, সৃষ্টি হয় নদী ভাঙ্গন। স্থানীয়রা বলেন, কিছুদিন আগে হঠাৎ তিস্তায় পানি বেড়ে বন্যা হয় তারপর শুরু হয় নদী ভাঙন। এলাকাবাসীর দাবি এবছর কয়েকশ হেক্টর ফসলি জমি, ঘরবাড়ি রাস্তা বিলীন হয়েছে তিস্তার ভাঙনে। তিস্তার বন্যা ও ভাঙ্গনে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমি, বসতবাড়ি আর গ্রামীণ সড়ক, তেমনি শুস্ক মৌসুমে নদীতে দেখা যায় পানির তীব্র্র সংকট। অথচ তিস্তা ভারত বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত অন্যতম একটি অভিন্ন নদী। শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় সেটি গত এক দশকেও আলোর মুখ দেখেনি। অভিন্ন নদী হিসেবে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না করে উজানে তিস্তার পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এই তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ইস্যুটি একটি অমীমাংসিত সমস্যা। দুই দেশের সম্পর্কের আলোচনায় তিস্তা একটি বড় ইস্যু। তাই দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হলে তিস্তা ইস্যুতে কী আলোচনা হয় বা সিদ্ধান্ত হয় সেটি নিয়ে বিপুল আগ্রহ থাকে বাংলাদেশের। এই আষাঢ়ের ঢলে যখন তিস্তার বন্যা এবং ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে সে সময়টিতে এক দ্বিপাক্ষিক সফরে ভারতে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত সফরে গিয়ে তিস্তা নিয়ে কী আলোচনা হয় সেটি নিয়েও তাই বেশ আগ্রহ ছিল বাংলাদেশে। তিস্তা জনপদের মানুষের আগ্রহ ছিল আরো বেশি। তবে এবারো শীর্ষ বৈঠক থেকে তিস্তা সমস্যার দ্রুত সমাধানের কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। বরং তিস্তা চুক্তি এড়িয়ে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত। যদিও তিস্তা চুক্তি সম্পাদন এবং বাংলাদেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ ছয় দফা দাবি পূরণে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে রংপুরে। উত্তরাঞ্চলে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ নামে এ সংগঠনের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বিবিসিকে বলেন, এবারের বৈঠকের ফলাফলে তিস্তাপাড়ের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়েছে। একটি পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কারিগরি টিম আসবে। তিস্তা চুক্তির কথা এখানে অধরাই থেকে গেছে। তিস্তা চুক্তির পরিবর্তে এখন বেশি আলোচনা হচ্ছে নদী ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রকল্প ঘিরে। উত্তরাঞ্চলে এটি তিস্তা মহাপরিকল্পনা নামে পরিচিত। এ প্রকল্পটি মূলত বাংলাদেশ অংশে বাস্তবায়ন করা হবে। তিস্তায় এ প্রকল্প যাচাই করতে বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পাওয়ার চায়না যৌথভাবে প্রায় তিন বছর সমীক্ষা করে। সমীক্ষা শেষে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনার একটি প্রস্তাব তৈরি করে। ওই প্রকল্পের আওতায় তিস্তায় নদী খনন, ভূমি উদ্ধার করে সেচ, নৌ চলাচল, পর্যটন, আবাসন ও শিল্পায়নের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়। এ প্রকল্প আর্থিক কারিগরি সহায়তা দিতে চীন যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে তখন তিস্তা প্রকল্পে নতুন প্রস্তাব নিয়ে সামনে এসেছে ভারত। অথচ তিস্তার পানির দাবিটা অনেক পুরোনো। সুতরাং ভারত যদি আমাদের তিস্তার প্রজেক্টটা করে দেয় তাহলে আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। সরকার প্রধানের বক্তব্য আর ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে অনেকে নিশ্চিত যে তিস্তা প্রকল্প এখন ভারতের মাধ্যমেই বাস্তবায়নের পথে এগুবে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যেটা এসেছে তাতে মনে হয় ভারতের মাধ্যমেই সম্ভবত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। স্পষ্টতই সেটা যদি হয় তাহলে দীর্ঘসূত্রতার পাল্লায় যে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে এটা ঝুলে যাবে এবং আগামী দুই চার বছরের মধ্যে এখানে বড় কোনো অগ্রগতির আশাও করা যাচ্ছে না। তাছাড়া পানি চুক্তি ছাড়া তিস্তা প্রকল্প সমস্যা সমাধানে কাজে আসবে না।আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকটা কাজে স্বচ্ছতা থাকতে হবে, জবাবদিহিতা থাকতে হবে। প্রত্যেকটা কাজে যারা স্টেকহোল্ডার তাদের সাথে অংশীদারিত্ব থাকতে হবে। চীনের সাথে কী হচ্ছে, আর ভারত যখন এসে বলেছে আমাদের প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে দেবে। কিন্ত এখনতো তার থেকেও পেছনে গেল। বিশেষজ্ঞদের মতে এ নদীর পানিতে উভয় দেশের অধিকার নিশ্চিত করতে অববাহিকা ভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার দরকার। এবং এর জন্য জলাধার নির্মাণ প্রয়োজন উজানে ভারতীয় অংশে। তিস্তা প্রকল্পে চীনের প্রস্তাব এবং ভারত কী করতে চায় তার কোনোটিই এখনো পরিস্কার নয় বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে। যেদেশই বাস্তবায়ন করুক না কেন কারিগরি দিক বিবেচনায় তিস্তা প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সমস্যার প্রকৃত সমাধান হবে না।মোটকথা, ভারত থেকে কতটা পানি আসবে সেটার সিদ্ধান্ত হতে হবে। এখন পর্যন্ত ভারত গায়ের জোরে শূন্য দিচ্ছে। এটাতো আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না। কাজেই বণ্টনের ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোনো ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা অনেকের কাছে অবাস্তব মনে হয়।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জীর প্রতিবাদের কারণেই নাকি তিস্তা চুক্তিটি হচ্ছে না। তিস্তা চুক্তি বা বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদীর জল বণ্টন চুক্তিগুলোর বিষয়ে দিল্লির যেমন সদিচ্ছা রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশও আগ্রহের সঙ্গেই অপেক্ষা করছে। তবে এ নিয়ে তৃণমূল নেত্রীকে দায়ী করা হলেও সমস্যাটি অন্য জায়গায় সেটি আলোচনায় স্থান পাচ্ছে না। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিবের ভাষায় গঙ্গা চুক্তিতে দুই প্রধান মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও কতগুলো মানানসই ব্যক্তিত্বের সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু তিস্তার বেলায়-মানানসই ব্যক্তিত্বের অনুপস্থিতিই তিস্তা ইস্যুটি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে বলে ধারণা করা ভুল হবে না। মমতা ব্যানার্জীকে এককভাবে দায়ী করা অযৌক্তিক বলেই মনে করি। মমতা ব্যানার্জীর কথা তিস্তায় জল নেই; পশ্চিম বঙ্গে যে পরিমাণ জল প্রয়োজন-সে পরিমাণ জলও পশ্চিমবঙ্গ পাচ্ছে না; কাজেই তিস্তা চুক্তি হলেই কী, আর না হলেই কী। যেখানে তিস্তার জলপ্রবাহ স্বাভাবিক নয়, সেখানে জলের চুক্তি হাস্যকর। এই হাস্যকর বিষয় নিয়ে আলোচনার ঝড় তোলা হচ্ছে।হ্যাঁ তিস্তার জল আমাদের এবং পশ্চিমবঙ্গের খুবই প্রয়োজন। ন্যায্যতার ভিত্তিতে জল বণ্টনে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তিস্তায় তো পানি নেই; এই কেনোর উত্তরটা খোঁজে বের করা জরুরি। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গোটা বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। ধনী বিশ্বের নাগরিকরা অতিমাত্রায় ভোগবিলাসে ডুবে থাকার জন্য প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে বদলে দিয়েছে। প্রকৃতি যদি গতিপথ হারায়, তবে নানা ধরনের দুর্যোগ নেমে আসে। আমরা সেই দুর্যোগে বসবাস করছি। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতি বছরই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় বহুমুখি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সম্মেলনে। কিন্তু যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটে না। আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কষ্টপায় সাধারণ মানুষ। কাজেই বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোন পথে হাঁটবে। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে। কোনো কোনো জায়গায় মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে, সেটি বোঝা খুবই জরুরি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মানানসই ব্যক্তিত্বের সম্পৃক্ততার বিকল্প নেই। তবে সাধারণের চেয়ে উৎকৃষ্টতার গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের ভাবনা দ্বারা তিস্তা চুক্তির বাধা দূর সম্ভব। দেশ, জনগণের স্বার্থ অনুধাবনমূলক মহান ভাবনাসম্পন্ন ব্যক্তি যদি দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তবে সেটি প্রসার লাভ করবে। একটি দীপ্ত প্রদীপ থেকে আরেকটি প্রদীপ প্রজ্জলনের মতো, তখন তা ধীরে ধীরে জনগোষ্ঠীর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। তিস্তা নিয়ে জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ তা দূর করতে হলে চুক্তিটি করতে হবে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণের আলোকে। কারণ তিস্তা প্রকৃতিরই নির্যাস। এটা ভারত, বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্ব ভালোই বুঝেন। কিন্তু জায়গাটি তৈরি করে দিতে হয়, মানানসই মহান ব্যক্তিত্বকে দিয়ে। আর তখনই হয়তো উভয় দেশ উপকৃত হবে। এবং উত্তরবঙ্গ মানুষের বহুমাত্রিক সংকটের লাগব হবে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |