গৌরব ও ঐতিহ্যে ৮৫ বছর
মেহেদী হাসান নাঈম
|
উত্তরের আলো বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ। উত্তরবঙ্গকে শিক্ষা নামের যে প্রদ্বিপ দিয়ে আলোকিত করছে ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যায়তন, সেই প্রদ্বিপের অগ্নিশিখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা বাংলাদেশে। মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে-মানবতার সেবক হও এই নীতিবাক্যে ৯ জুলাই, ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যায়তনে বর্তমান প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছে নিজেদের শিক্ষাজীবন। ৮৫ বছরের এই পথ চলায় কখনো কখনো একক ভাবে সরকারি আজিজুল হক কলেজের ফলাফল কোনো কোনো শিক্ষা বোর্ডের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট ফলাফলের চেয়েও বেশি হয়েছে। ৮৫ বছরের আজকের এই ঐতিহ্য আর গৌরব সরকারি আজিজুল হক কলেজ জানান দিয়েছিল তার প্রতিষ্ঠালগ্নেই। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের প্রাক্কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষপঞ্জিতে ২১৬ টি অধিভুক্ত কলেজের তালিকা প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে সাতাশটি কলেজ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বা বর্তমান বাংলাদেশে। এগুলোর মধ্যে উত্তরবঙ্গের প্রধান ও শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পরিণত হয় বর্তমান এই কলেজ আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া। অবিভক্ত বঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী স্যার আজিজুল হক এর নামে কলেজটির নামকরণ করা হয়েছে। কলেজের যাত্রা শুরুর প্রায় দুই বছর পর্যন্ত কলেজের ক্লাস অস্থায়ীভাবে বর্তমান সুবিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেয়া হয়। পরবর্তীতে এটি ফুলবাড়ি বটতলাতে স্থানান্তরিত করা হয়। শুরুতে প্রায় ২০০ জন শিক্ষার্থী ছিল কোন ছাত্রী ছিল না। ১৯৪১ সালে কলেজের প্রথম ব্যাচের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় ১৫২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১০৭ জন পরীক্ষায় পাশ করে। পাশের হার ছিল ৬৯.২%। অথচ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হার ছিল ৬৩.৪%। ১৯৪৩ সাল থেকে কলেজে ছাত্রী ভর্তি শুরু হয় এবং এই সংখ্যা ছিল ৮ থেকে ১২ জন। পরবর্তীতে এই সংখ্যা কিছু বৃদ্ধি পায়। এরপর ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ছাত্রীরা সকালের শিফটে বর্তমান ভি.এম গার্লস স্কুলে ক্লাস করত। সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও সরব উপস্থিতি ছিল এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের। শহীদও হয়েছেন বেশ কয়েক জন। বিদ্যায়তনটির শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যিক শাহেদ আলী, কবি আতাউর রহমান। এ ছাড়া কণ্ঠশিল্পী শওকত হায়াত খান, কবি মহাদেব সাহা, ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. আনোয়ার হোসেন, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ড. এনামুল হক, শিক্ষক মমতাজুর রহমান তরফদারসহ অনেক গণ্যমান্য এই কলেজে পড়েছেন। ৯ জুলাই ১৯৩৯ প্রতিষ্ঠাকালে যে অর্জন আর সুনাম, তার ধারাবাহিকতা এখনও অব্যহত রয়েছে। ২০২৩ সালে এই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১ হাজার ৩৩৪ জন, পাস করেছেন ১ হাজার ৩৩৩ জন। আর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৮ জন। উত্তরের আলো হিসেবে খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানে এখন উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও ২৩টি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ আছে। কলেজের নতুন ক্যাম্পাসে দৃষ্টিনন্দন প্রশাসনিক ভবন, কলা ভবন, চারতলা বিজ্ঞান ভবন, পাঁচতলা ব্যবসায় শিক্ষা ভবন, দোতলা গ্রন্থাগার ছাড়াও চালুর অপেক্ষায় আছে বহুতলবিশিষ্ট অত্যাধুনিক একাডেমিক ভবন। ১০০টি শ্রেণিকক্ষ ও ১৮টি গবেষণাগারে পাঠদান যে পুরোদমেই চলে। উত্তরবঙ্গের মেধাবী বা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় ভরসা এখন সরকারি আজিজুল হক কলেজ। উচ্চশিক্ষায় যুগোপযোগী আরও ১৯টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালুর জন্য আবেদন করেছে কলেজ প্রশাসন। এই উদ্যোগ বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। “মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে মানবতার সেবক হও“ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-এ চারটি মৌলিক অনুষঙ্গ ঘিরে সরকারি আজিজুল হক কলেজের চলছে এক অনবদ্য পথচলা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক সম্মান, সৌহার্দ্য ও শ্রদ্ধা-স্নেহের রসায়নে আবদ্ধ। দেশ-বিদেশে সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বমহিমায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৩৯ সালের ৯ জুলাই প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান আয়তন ৬৩ একর। প্রায় ২২,০০০ পুস্তক সমৃদ্ধ পাঠাগার জানান দেয় ঠিক কতটা সমৃদ্ধ এই বিদ্যায়তন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পারফরম্যান্স র্যাংকিং’–এ ৬৮৫টি কলেজের মধ্যে এই কলেজের অবস্থান তৃতীয়। প্রতি বছর সেরা ৩ এ জায়গা দখল, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে সাফল্য, কোটি টাকার স্কলারশীপে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ লাভ কিংবা জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন সকল ক্ষেত্রেই নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠাকালের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোজাম পাইকার, আমীর আলী, শফিকুর রহমান, আব্দুল মালেক, নূরুল ইসলাম ভোলা থেকে শুরু করে বর্তমানের আমি, নাহিন ফয়সাল, রাশেদ হোসেন, নূর আফরিন কিংবা তোহিরা আকতার সকলের হৃদয়ের অনেকটা গভীরে এই কলেজের স্থান। আধুনিকায়নের ছোয়ায় উন্নত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। বদলে গেছে ছাত্র, শিক্ষক আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদচিহ্ন। কিন্তু ৮৫ বছরের গৌরব ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সরকারি আজিজুল হক কলেজের পুরোনো ভবন। নতুন ক্যাম্পাসের ৬৩ একর আয়তন নতুন করে সম্ভাবনার হাতছানি দেয়। জন্মদিনে প্রত্যাশা এটুকুই ৮৫ বছর নয়, ৮৫ আলোকবর্ষ শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিক প্রাণের সরকারি আজিজুল হক কলেজ। লেখক : শিক্ষার্থী ,সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া। ডেল্টা টাইমস্/মেহেদী হাসান নাঈম/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |