সহযোগিতা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিন
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো সামগ্রিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।এটি মূলত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল।তাঁরা যে ধরনের চিন্তা ও প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলন করেছেন, রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে এই অর্জন ধরে রাখা যাবে না। এ কারণে সরকারের কর্মকাণ্ডে আন্দোলনের সংগঠকদের সম্পৃক্ত করা জরুরি।মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত এমন ব্যবস্থা চালু করা গেলে দেশের বিভিন্ন সমস্যার বাস্তব চিত্র উঠে আসবে এবং সমাধান করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিগত সময়েও সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই গণ-অভ্যুত্থান ছিল রাজনৈতিক দলের। এবারই প্রথম ছাত্র-জনতা রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। সেই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও নেতৃত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের হাতেই। তাঁদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও ছিল সামনের কাতারে। সে কারণে এই অভ্যুত্থানের বাস্তবতা ভিন্ন। ছাত্ররা একটি পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিল। রাষ্ট্র সংস্কার করতে চেয়েছিল।এখন তারা সেই সুযোগ পেয়েছে বিগত সময়ের সরকারব্যবস্থায় মন্ত্রী-এমপি কিংবা উপদেষ্টাদের সঙ্গে জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না। সে কারণে অনেক অভাব-অভিযোগের বিষয়ে সাধারণ মানুষ কোনো সমাধান পায়নি। শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা হয়েছে, এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। পাশাপাশি সহ-উপদেষ্টা হিসেবে যদি শিক্ষার্থীদের রাখা হয়, তাহলে তারা জনগণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারবে। কারণ তারাই এসব সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। এর ফলে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা যাবে, যা একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আগে থেকেই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হলে সেটি খুবই ন্যায্য এবং প্রাসঙ্গিক হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। তাই রাষ্ট্র মেরামত করতে সময়ের প্রয়োজন। আর সেই সময়টা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিতে হবে। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য সময় লাগবে। সেই সময়টুকু দিতে হবে। গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকারের নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে তারা কখন এই সরকারকে বিদায় দেবেন। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে তারা এই দায়িত্ব নিয়েছেন। সরকার সব শক্তি দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করবে। এদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের অতি দ্রুত সংলাপ চেয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, কয়েকজন ব্যক্তির সংস্কারে তাদের বিশ্বাস নেই। নির্বাচন অবশ্যই সীমিত সময়ের মধ্যে করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, রাষ্ট্র মেরামত করবে নির্বাচিত সরকার। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সংলাপ চান। তিনি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণারও দাবি করেছেন। বলতে গেলে এখন বিএনপির পথ পরিষ্কার। এখন তো আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই। কাজেই তাদের জন্য খালি মাঠে গোল দেওয়া একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও সময় দিতে রাজি নন। তবে জামায়াত বলেছে, তারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দিতে রাজি। ছাত্র আন্দোলনের ফসল এই অন্তর্বর্তী সরকার। ড. ইউনূসকে তারা পছন্দ করে এনেছেন। দেশে আসার পর ড. ইউনূস ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি আমাকে চান, তবে আমার কথা শুনতে হবে। তা না হলে আমাকে বিদায় দেন, আমি আমার কাজে ফেরত যাই।’ ড.মুহাম্মদ ইউনূস মূলত কোনো রাজনীতিবিদ নন। তার রাজনীতি করার ইচ্ছা আছে বলেও মনে হয় না। তিনি বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ যেভাবে সাজিয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি। তারাও যে রাজনীতিতে জড়াবেন, এমন কোনো আশঙ্কা নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার চায় আন্তর্জাতিক মহল। ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ অনেক দেশই আশা প্রকাশ করে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্বাচন দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কাজেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বর্তমান সরকার নির্বাচন দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই বা থাকার কথাও নয়। এদিকে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে কথা উঠেছে। বিএনপি বলছে, জনগণের সরকার বা নির্বাচিত সরকারই রাষ্ট্র সংস্কার করবে। রাষ্ট্র সংস্কার আমি বা আমরা দেখে আসছি স্বাধীনতার পর থেকেই। কখনো একদলীয় শাসন, কখনো সেনা শাসন, দেখেছি গণতান্ত্রিক শাসন, আর গত সাড়ে ১৫ বছর দেখলাম এক ব্যক্তির শাসন। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল এই জাতির ভাগ্যে খুব একটা জোটেনি। বরং জাতি হিসেবে আমরা হয়েছি অবহেলিত, লাঞ্ছিত আর বঞ্চিত। গণতন্ত্রের দাবিতে দেশ স্বাধীন হলেও গণতন্ত্রের স্বাদ এই জাতি ভোগ করতে পারেনি। গণতন্ত্রের নামে এদেশে স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র আর একনায়কতন্ত্রই দেখেছি। এদেশের মানুষ চায় দুবেলা দুমুঠো খেয়ে শান্তিতে ঘুমাতে। আর সেটা স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও হয়ে ওঠেনি। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে রাজনীতিবিদরা বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। বিদেশের ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়েছেন। সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনে দেখা গেছে, রিকশাচালক, দিনমজুর বা খেটে খাওয়া মানুষ সমর্থন দিয়েছেন। ঢাকার রিকশাচালকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন এবং উৎসাহ দিয়েছেন। শুধু কি তাই? পুলিশের গুলিতে রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। আমরা দেখেছি ৫ আগস্টের পর তাদের আনন্দ-উল্লাস। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়েছেন,যে যা পারেন তাই নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার পরপরই দেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, যার প্রভাব এখনও কাটেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আসা পানিতে এখন দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চলছে ভয়াবহ বন্যা। ৯ জেলায় প্রায় ৪ কোটি মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে কীভাবে নারী ও শিশুদের মৃতদেহ পানিতে ভাসছে। এ এক মানবিক বিপর্যয়। ছাত্রসমাজ বন্যার্তদের সাহায্যে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে যে যা পারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে। দেশে এই মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে সব রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে-এটাই আশা করছি। আর রাজনৈতিক দলগুলো এটাই করবে বলে আমাদের আশা। কিন্তু তা না করে আগে ক্ষমতার চিন্তায় মগ্ন। কবে, কীভাবে নির্বাচন দিতে হবে, কবে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা হবে বা করতে হবে, তাই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত। ছাত্র বা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল কি রাজনৈতিক দলগুলো এত তাড়াতাড়ি ভোগ করতে চায়? শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে। ড. ইউনূস একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তাকে শিক্ষার্থীরাই সাময়িকভাবে রাষ্ট্র মেরামত করার দায়িত্ব দিয়েছে। সেইসঙ্গে শস্ত্রস বাহিনীও কাজ করছে। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারীদের ধরা হচ্ছে। রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করেছেন, তাদেরও ছাড়া হচ্ছে না। ধরা হচ্ছে রাজনৈতিক দালালদের। চালানো হচ্ছে পরিচ্ছন্ন অভিযান। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, ব্যাংক লুটকারী, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অবৈধ অর্থ আত্মসাৎকারীসহ সবাইকে ধরা হচ্ছে। বিএনপি বলছে, তারা রাষ্ট্র মেরামত করবে, তারা কি এত সহজেই রাষ্ট্র মেরামত করতে পারবে? দেশে এখন বৈদেশিক ঋণ প্রায় ১১ বিলিনয় ডলার। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ কোটি টাকা। দেশ থেকে গত সাড়ে ১৫ বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ১০৯ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং বলাই যায়, দেশের অর্থনীতি এখন পঙ্গু। ব্যাংকে টাকা নেই। এমতাবস্থায় বিএনপি কি রাতারাতি দেশের অর্থনীতি ঠিক করতে পারবে? নির্বাচিত বা গণতান্ত্রিক সরকার সবাই চায়। তবে তার আগে দেশের মানুষ ভাত চায়। ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে। বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টাও একজন অর্থনীতিবিদ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আর রাষ্ট্র মেরামতের কাজ আপাত দৃষ্টিতে ভালোই করছে বলা যায়। দেশবাসীর বিশ্বাস, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তারা যদি তৃণমূল সব ক্ষেত্রে তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিতে পারেন, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্ভব হবে। সর্বোপরি কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের সংস্কার আমরা সবাই চাই। দীর্ঘদিন থেকে গড়ে ওঠা একটি সিস্টেমকে ভাঙতে দেশের সরকার এবং জনগণ উভয়েরই বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। আমাদের সমাজের দিকে তাকালে প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য, যা অতি দুঃখের হলেও সত্য। আজকের আধুনিক বিশ্বের ছোঁয়া সত্ত্বেও আমরা সেকেলে সমাজব্যবস্থা হতে বেরিয়ে আসতে পারিনি। একটি সমাজে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সব রকম মানুষের বাস। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা সব রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, কিন্তু সমাজে যারা গরিব সহায়-সম্বলহীন তারা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে দুঃখ কষ্টের কঠিন জীবনকেই মেনে নিতে বাধ্য হয়। স্বার্থকেন্দ্রিক বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সুখ নেই। প্রকৃত সুখ রয়েছে সমাজের জন্য, দেশের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কিছু করে বাঁচার মধ্যে। একজন মানুষ সঠিক শিক্ষা গ্রহণ না করলে তার প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। সে কারণে আমাদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। একটি কথা মনে রাখা ভালো, সমাজ নিয়ে ভাবনার বয়স লাগে না, প্রয়োজন চিন্তা ও মানসিকতা। শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলে সমাজের কোনো পরিবর্তন আসবে না। ভাবতে হবে চারপাশের মানুষ নিয়ে। পরিবর্তন ছাড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের সবার মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধই পারে সমাজের রূপ বদলে দিতে। আমাদের দেশে এখন যেসব রাজনৈতিক দল আছে, সেগুলো তো পরীক্ষিত। তবে যাই হোক, দেশ তো রাজনীতিবিদরাই চালাবেন। এত তাড়াহুড়া কেন? সাড়ে ১৫ বছর সইতে পারছেন, আর না হয় কিছু দিন অপেক্ষা করুণ। কেন এত অস্থিরতা? অপেক্ষা করুন,দেখুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র মেরামত করতে পারে কি না। তবে আর যাই হোক দেশের কোন ক্ষতি হোক এমনটা চাইবেন না ড.মুহাম্মদ ইউনূস।তাই ধৈর্য ধরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিন। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |