রিসেট বাটন ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
মোজাফফর হোসেন ভূইয়া:
|
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশ থেকে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিতারিত করা হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেনা বাহিনীর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার সময়সীমা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ও সংস্কারের রুপরেখা তৈরির কাজে ব্যস্ততম সময় পার করছেন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। দায়িত্ব বন্টন ও পুর্নবন্টনের কাজে বিভিন্ন অসংগতি থাকলেও বাংলার জনগন আশায় বুক বেধে অপেক্ষা করছে অবাদ সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারে জন্য। কখনো সে আশা সোনালি হাঁসিতে ভরিয়ে দেয় আবার তাতে দেখা দেয় ঘন কোয়াশা ও অন্ধকার। সংস্কার শব্দটি আমাদের মনে আশা জোগালেও বাস্তব বিভিন্ন উদ্যেগ সাধারন মানুষের মাঝে তৈরি করছে হতাশা। অন্তরবর্তী সরকার কোন দল বা গোষ্ঠির সমর্থনে গড়ে উঠা সামাজিক সম্প্রিতির অন্তরায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে সে সরকার হয়ে উঠছে একটি বিশেষ দলের বা চেতনার প্রতি বিশ্বাসী। এ সরকারের হওয়া উচিত বাংলার সকল মানুষের জন্য। যেখানে ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে অন্যায়কে প্রতিহত করা হবে, যেখানে মানুষ তার আত্মমর্যাদা ফিরে পাবে। আমরা জবাবদিহিতা নিশ্চিত একটি বাংলাদেশ চাই। আমরা চাই আমাদের বাকস্বাধীনতা আর নিরাপত্তা। বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য যে রিসেট বাটন চাপা হয়েছে তা শুনে খুশি হয়েছি কিন্তু বাস্তব প্রয়োগ পদ্ধতি আমাদের হতাশ করছে। আমরা কি সুশাসনের পথে এগুচ্ছি নাকি আমাদের সামনে আরেকটি ভয়ংকর দুঃশাসন অপেক্ষা করছে?
আমরা যা দেখছি আর যা মোকাবেলা করছি তা আমাদের কাম্য নয়। আমরা যে মহান ব্যক্তিকে পেয়েছি তিনি কেন আমাদের হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করবেন? আমরাতো মনে করি তিনি যেমন বিএনপির, জামায়াত, সাধারণ মানুষের তেমনি তিনি আওয়ামী লীগেরও, তিনি সকল সাধারন মানুষের, তিনি যেমন নিরপরাধ মানুষের জন্য আবার তিনি অপরাধীদেও জন্যও। কারন অপরাধীদের সুপথে নিয়ে কার্যকর মানব সম্পদে পরিণত করার উদ্যোগের বড় অভাব আমাদের দেশে। তিনি যেমন একজন ভাল মানুষের জন্য তেমনি একজন পাপী মানুষের জন্যও। সুশাসন ও নিরপেক্ষতা তার জীবন দর্শন যা অপরাধী বা পাপীকে সুপথ দানে সহায়তা করবে। সুতরাং তিনি যে রিসেট বাটনে চাপ দিয়েছেন তা হতে হবে নিরপেক্ষ ও আইনসিদ্ধ। আমরা হতাশার দ্বারা স্নান করতে প্রস্তুত নই। বিগত অর্ধশত বছর এই নোংরা সাগরে স্নান করতে করতে শরীরের শত চর্মরোগ আজ মনের মাঝে ক্ষত তৈরি করছে। আমরা এই ক্ষত সারাতে চাই। আমরা গণতন্ত্র চাই আমরা চাই প্রতিহিংসাহীন নতুন সমাজ। আমরা ঘুনে ধরা এই সমাজকে মানবিক সমাজে রুপান্তর করতে চাই। নিধন মানষিকতা থেকে সম্প্রিতির বন্ধন চাই। আসমতাহীন সমাজ চাই। আমাদের চাওয়া কোন কালেই খুব বেশি ছিল না। আমরা সুন্দর সমাজ চেয়েছি। ভাল ভাবে বাঁচতে চেয়েছি অতীতের কোন শাসকের মনে আমাদের প্রতি কোন দয়া দরদ বা দায়িত্বশীলতা ছিলনা। আমরা না পেয়েছি সুশাসন না পেয়েছি কোন অধিকার । আমাদের চামড়া খোলেছে বিএনপি জামাত সরকার, অওয়ামীলীগ সরকার । আমাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করেছে প্রশাসনিক অপশাসন। আমরা এমন প্রশাসনিক অপশাসন থেকে মুক্তির নেশায় ছুটেছি যুগ যুগ ধরে। আমরা পুলিশকে বন্ধু হিসেবে পাইনি কোন কালে। সরকারি আমলাদের কাছে সকল কালেই আমরা ছিলাম অসহায়ের মতো। আমরা এমন একটি নেতিবাচক পরিবেশ থেকে মুক্তির নেশায় তরুন আন্দোলনের সাথী হয়েছি। আমরা বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ বুঝিনা আমরা চাই সুন্দর জবাবদিহিতামুলক সুশাসন। কিন্তু আমরা আবার নতুন করে বঞ্চিত হচ্ছি। দেখছি প্রতিহিংসার রাজনীতি। দেখছি সাধারন মানুষ মামলার ভয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। গ্রেপ্তার আতংকে সমাজ আজ অস্থিতিশীল। আমরা বর্তমান সরকারের কাছ থেকে জানতে ও বুজতে পেরেছি সংস্কার কাজে তারা ব্যস্ত। সমাজকে নতুন করে গড়ে তুলতে সেটিংস পরিবর্তনের কাজে হাত দিয়েছে। সব কিছুকে রিসেট করা হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো আমাদের চোখে বিভিষিকাময় রিসেট দেখা যাচ্ছে। যার ভিতর হিংসা, প্রতিহিংসা ও ক্রোধকে লালন করা হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। এখানে রিসেট বলতে আমরা যা দেখছি তা সংস্কার নয় অনেকটা অপসংস্কার বলেই মনে হচ্ছে কারন- রিসেট মানে, ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার অপচেষ্ঠা। ত্রিশ লক্ষ শহীদের জীবনদানের বিষয়কে উপেক্ষা করার জন্য নতুন ক্রাইসিস সৃষ্টি করা। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেপ্তার আর লাঞ্চনা করার পায়তারা। গরীবের সব ভাতা বন্ধ করে দিয়ে সামজে নতুন বৈষম্যের দিকে ঠেলে দেওয়া। রাজাকার আলবদর আলশামস ও স্বাধীনতা বিরুধীদের পুর্নবাসন ব্যবস্থা করা। রিসেট মানে বঙ্গবন্ধুকে অপমান আর তার অস্থিতক্বে মুছে ফেলার পায়তারা। তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে লুঙ্গি ড্যন্সের মতো বিদ্রুপাত্তক আচরণ। তার ভাস্কর্য ভাংচুর ও তাকে লাঞ্চিত করার বাসনা। রিসেট মানে বাংলার বুকে জিন্নার মৃত্যুদিবস পালন। মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান আর অপদস্ত করার নতুন ইতিহাস তৈরির চেতনা জাগানো। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা নিয়ে বিরুপ প্রশ্ন তোলা নাকি মানুষের মাঝে সৃষ্টি করা ভয় আর আতংক। রিসেট মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রের হাতে শিক্ষককে লাঞ্চনা। রিসেট মানে ছাত্রলীগের হাত থেকে ছাত্রদল আর শিবিরের হাতে প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর । আরা রজনীতি মুক্ত নতুন আঙ্গিকে শিক্ষা পরিবেশ চাই। ছাত্র শিক্ষকের সুন্দর মানবিক সম্পর্কের জাল বুনতে চাই। রিসেট মানে একটি অপশাসন থেকে আরেকটি অপশাসন তৈরির প্রচেষ্ঠা। সার্বভৌমত্মকে হারানোর নতুন পদ্ধতি সৃষ্টি করা। আমরা ভারতে ঔপনিবেসিকতার ক্ষপ্পর থেকে আমিরিকার হাতে লাঞ্চিত হওয়ার নতুন কোন ইতিহাস তৈরির পায়তারা চাই না। রিসেট মানে বকধার্মিকদের দ্বারা নতুন কোন দুঃশাসন তৈরির পথ খোঁজা। ধর্মীয় বিদ্ধেসের মাধ্যমে একটি সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা। মন্দির ভাঙ্গা, মসজিদ ভাঙ্গা, পীর মাজার ভাঙ্গা নাকি মসজিদে এক পক্ষ অন্য পক্ষের সাথে দাঙ্গাবাজিতে নিয়োজিত হওয়া। আমরা সুশাসনের মাধ্যমে মানবিক ধর্মীয় মুল্যবোধের বিচরণ চাই। রিসেট মানে গণগ্রেপ্তার আর চেতনায় আঘাত করা। লাঞ্চিত করার নতুন কোন পথ তৈরিতে কাজ করা নাকি হাঙ্গামার মাধ্যমে সমাজকে অস্থিতিশীল করা। বর্তমানে গ্রাম গঞ্জ শহর সব স্থানে সাধারন মানুষকে গ্রেপ্তার করে জেলখানা ভরে রাখার এক অশুভ কাজে লিপ্ত বাংলার পুলিশ, র্যাব আর যৌথবাহিনী। রিসেট মানে শিষ্টাচার, শুদ্ধাচার বহির্ভুত রাজনৈতিক পরিবেশ। হিংসা বিদ্বেস আর হানাহানিতে ব্যস্ত সকল কার্যক্রম। প্রতিপক্ষ কে ঘায়েল করার যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া তা চলমান রাখার অপকৌশল। হত্যা খুন গুমের যে নষ্ট রাজনীতি রয়েছে তা নতুন আঙ্গিকে ধরে রাখার এক নতুন পদ্ধতির অপসিদ্বান্ত। আমরা মানবিক ও সুন্দও আচরণ চাই। হিংসা বিদ্বেস মুক্ত নতুন সমাজ চাই। রিসেট মানে বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। কাউকে কিছু বলতে বাধা প্রদান। আপন মনে বলতে না পারার অপকৌশল। লিখতে গেলে হাত কাঁপে আজ বলতে গেলে মুখ এটাই হলো রিসেট ভাবি হারিয়ে সব সুখ। বিগত সব সরকারে হীনতা থেকে মুক্ত স্বাধীনতার প্রত্যশায় দিন গুনি। রিসেট মানে বিচরণ সীমাবদ্ধতা। তোমার স্বাধীন পথের বাঁধা। বুদ্ধিজীবিদের হত্যা আর তাদের এক ঘরে করা। ভাষা বলার সাহস তোমার থাকবে না আর মনে। যেথায় যাবে হতাশা আর জীবন নাশের ক্ষনে। রিসেট মানে ছাত্র দ্বারা শিক্ষক হবে লাঞ্চিত। এরকম রিসেট আমাদেও কাম্য নয়। আমরা সুন্দর স্বপ্নময় এক রিসেটের আশায় দিন গুনছি। রিসেট মানে কোটা প্রথার নতুন রুপ। যে কোটা বিলুপ্তির জন্য হাজারও প্রান হারিয়েছে। আজ সেই প্রথা অন্য কোন গোষ্ঠির জন্য একই রুপে ফিরে আসলে আবারও সেই রুপে নতুন কোন বিপ্লব সম্ভাবনা আমাদের সামনে। আমরা আসলে স্বার্থপর কারন আমরা আমাদের জন্যই কাজ করি। নিজেদের স্বজনদের উন্নত জীবন দানে বাজট করি যা আগেও হয়েছে এখনও হচ্ছে। তবে আমরা কাকে দোষারোপ করব। নতুন স্বাধীনতা আর পুরাতন স্বাধীনতার খেলায় আজ অতিষ্ট জাতি। রিসেট মানে ভায়ে ভাইয়ে চেতনাগত দ্বন্দ সৃষ্টির কোন পায়তারা নাকি সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরিতে উৎসাহদান। রিসেট মানে এই নয় যে প্রতিটি ঘরে ঘরে নতুন কোন সন্ত্রাস জন্মদানে সহায়তা। আমরা সাধারণ মানুষ আমার ভাই আমার আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক চেতনার সাথে সম্পৃক্ত। প্রতিটি মানুষই তার ব্যক্তিগত মতপার্থক্য নিয়ে সমাজে বসবাস করে। এখানে মিলেমিশে বসবাস করার মাষিকতাই হলো প্রকৃত মানবতার প্রকাশ। বিগত সকল সরকার ব্যবস্থাপনায় চেতনাগত মতপার্থক্যকে গড়ে তোলা হয়েছিল হিংসাত্বক আর অমানবিক। মনুষ্যত্ব নামক উপাদান বিলুপ্ত । কিন্তু বর্তমান সময়ে অওয়ামী কর্মীদের ধরপাকর আর হত্যা এক নতুন হিংস্র ইতিহাসের জন্ম দিচ্ছে যা সুশীল মানষিকতা সমর্থন করে না। আমরা অতীত দুঃশাসন ব্যবস্থার সাথে বর্তমান সরকারের কাজের তুলনা করতে চাই না। কারন আমরা বর্তমানে শাসন ভার দিয়েছি এমন একজন বিশ্ববিখ্যাত মানুষকে যিনি পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের আদর্শ। তিনি শুধু বাংলাদেশের লোক নন। তিনি সারা বিশ্বের একজন সুপরিচিত মহামানব। কিন্তু তার কাছ থেকে আমরা আমাদের মহান মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসের সুন্দর ব্যাথ্যা কামনা করি। আমরা কামনা করছি সুবিচার সুশাসন ও ভবিষ্যৎ সুশাসনের নিশ্চয়তা। লেখক: কথা সাহিত্যিক ডেল্টা টাইমস্/মোজাফফর হোসেন ভূইয়া/সিআর/একে |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |