প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ভোগান্তি
মো.হাসানুর ইসলাম
|
জীবন জীবিকার তাগিদে মানুষকে প্রতি নিয়ত ছুটতে হয় বিভিন্ন গন্তব্যে। নিজের জীবন পরিচালনার পাশাপাশি পরিবারের মানুষের দ্বায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে রোজগারের তাগিদে নিরন্তর ছুটে চলেছে মানুষ। মাঝে মাঝে এ যাত্রা দেশের গন্ডি পেরিয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শেষ হচ্ছে অন্য দেশে গিয়ে। এ যাত্রায় পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও সহযাত্রী। কর্মহীনতা ও পরিবারের ভরন পোষাতে না পেরে এ ত্যাগ স্বীকার করছেন বহু নারী। অনেকে আবার স্বামী সন্তান রেখে অচেনা গন্তব্যে যায় অভাবের অবসান ঘটানোর প্রয়াসে। তাদের এ নির্মম ত্যাগ, পরিশ্রম আর ঘাম ঝরিয়ে পাঠানো রেমিট্যান্সে সচল আমাদের দেশের অর্থনীতি। কিন্তু তাদের এ যাত্রা মোটেও মসৃণ নয়। নানান শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন অনেকে। নিজ পরিবারের স্বচ্ছন্দ ফিরিয়ে আনতে মুখ বুঝে সহ্য করছেন অসংখ্য নারী। অনেকেই আবার উপায় না পেয়ে দেশে ফিরে আসছেন কিংবা বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত। খুব কম সংখ্যক নারীর ভাগ্যই প্রসন্ন হয়। যুদ্ধ বিদ্ধস্থ নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে জনশক্তি রপ্তানি করা। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যেতে শুরু করেন নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিদে। নিজেদের বেকারত্ব হ্রাসের পাশাপাশি তাদের প্রেরণকৃত রেমিট্যান্স দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা আসতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ২০ ডিসেম্বর 'প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ' নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। প্রবাসী নারীর বড় একটি অংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গৃহকর্মী হিসেবে। ২০১৪ সাল থেকে সৌদি আরবে বড় পরিসরে নারী কর্মী যাওয়া শুরু করে। এছাড়াও আরব আমিরাত, জর্ডান, কাতার,লেবানন ইত্যাদি দেশে যায় এই নারী কর্মীরা। অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে বেড়েছে প্রবাস যাত্রার ব্যয়, বিদেশেও বিভিন্ন ভাবে প্রতারিত তারা। মধ্যস্বত্ত ভোগীদের কারনে গুনতে হয় বিপুল টাকা। কিন্তু এতো টাকা খরচ করে এবং এতো ত্যাগ শিকার করেও তারা নানান বিড়ম্বনার শিকার হয়। যে সকল নারীরা কর্মী হিসেবে বিদেশে যায় তারা প্রায় অশিক্ষিত এবং অদক্ষ যার কারনে অন্যান্য কাজের সুযোগ থাকলেও যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাবেতাদের গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে হয় বিভিন্ন বাসা বাড়িতে। খুব অল্প সংখ্যক নারী ভালো মালিকের সান্নিধ্যে থাকলেও অধিকাংশ পড়ে বিড়ম্বনায়। সুনির্দিষ্ট চুক্তি না থাকায় তাদের কাজ করতে হয় অধিক সময়, নেই কোন ছুটির ব্যাবস্থা,বেতন পায় না ঠিকমতো, এরইমধ্যে কাজে সামান্য ক্রটি হলেই মারধরের শিকার হতে হয় অনেককে। এরপর আসে সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং অসহনীয় সেই যৌন নির্যাতন। বিভিন্ন ভয় কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে জোর পূর্বক যৌনসম্পর্কে বাধ্য করা হয় অনেক নারীকে। যার ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করেন অনেক নারী। দেশীয় নাগরিকদের প্রবাসে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান ও স্বার্থ রক্ষায় নিমিত্ত বিদেশে স্থাপন করা হয় রাষ্ট্রীয় দূতাবাস। কিন্তু অনেক নারী কর্মী জানে না নির্যাতনের শিকার হলে কিভাবে দূতাবাসে অভিযোগ করতে হয়। অনেকেই আবার লোকলজ্জার ভয়ে অভিযোগ করতেও দ্বিধাবোধ করে, যার শেষ পরিনতি হয় আত্মহত্যা। যারা অভিযোগ করে তারাও যে বিচার পাই এমন নজির পাওয়া দুঃসাধ্য। তাদের সেফ হোমে রেখে দেশে ফিরত পঠানোই যেন তাদের প্রাপ্য বিচার। এ বিষয়ে তদারকির দায়িত্ব দূতাবাসের থাকলেও তারা জানায়, তাদের লোকবল ও সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে ঠিকমতো খোঁজখবর রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারনে ২০২০ সালের শুরুর দিক থেকে বিদেশে জনশক্তি পাঠানো প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আসা প্রবাসী আয় কিছুটা হ্রাস পেলেও বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে রেমিট্যান্স। গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশান এন্ড ডেভেলপমেন্ট এর তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে ২০২০ সালে বাংলাদেশ আরো একধাপ এগিয়ে ৭ম হয়েছে যা ২০১৯ সালে ছিলো ৮ম অবস্থানে। এ অসীম অবদানের পিছনে পুরুষের পাশাপাশি নারী কর্মীর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। মোট নারী প্রবাসগামীদের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ যায় সৌদি আরবে। সেখানে তাদের কাজ মূলত গৃহকর্মী। করোনা মহামারীর কারনে ২০২০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত তেমন সংখ্যক শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হয় নি। এর আগে এমপ্লয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং ( বিএমইটি) এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৪ লক্ষ ৭০ হাজার ২৬৫ জন নারী শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যায়। ব্রাক মাইগ্রেশনের তথ্য মতে ঐ বছরের দশ মাসের মধ্যে ৯৫০ জন নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছে এবং এর সাথে ৪৮ জন নারীর মৃতদেহ ফেরত আসে। অন্যান্য দেশেও নির্যাতনের চিত্র প্রায় একই। এরই ফলশ্রুতিতে প্রবাসে নারী কর্মী গমনে অনীহা দেখা দিয়েছে, আগ্রহ হারাচ্ছে অনেক নারী। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থাকলেও আসলে কতটুকু সুরক্ষা তারা পাচ্ছে এবং কতোটা কল্যাণ তাদের নিশ্চিত হলো তা এখনো অজানা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে অনেক গুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ সামান্য, যা দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে অনেকটা উত্তরণ সহজ হবে। যাদের এই সুমহান ত্যাগ ও ঘাম ঝরানো টাকায় অগ্রসর দেশের অর্থনীতি , দেশে তাদের মর্যাদা শোচনীয়। সমাজের অনেকে তাদের দিকে কটু দৃষ্টি আরোপ করে এমনকি পরিবারেও তারা অবহেলিত। এমন দৃষ্টি ভঙ্গি বদলাতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিতে হবে আরো কার্যকরী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। নিশ্চিত করতে হবে তাদের প্রাপ্য অধিকার,সুরক্ষা এবং মর্যাদা। তাদের অভিযোগে দ্রুত তদন্ত করতে হবে এবং বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। তবেই দেশে নারী বেকারত্বের হার কিছুটা হলেও কমানো যাবে এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে,নারী অপরাধ প্রবনতাও হ্রাস পাবে। দেশের অর্থনীতি হবে আরো সমৃদ্ধশীল। লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস/মো.হাসানুর ইসলাম/সিআর/আরকে |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |