নদীগুলো মৃত্যু হলে আমরা কি নদী সৃষ্টি করতে পারব
রাশেদুজ্জামান রাশেদ
|
![]() . এ দেশের মানুষ নদীর পানি দিয়ে আঁশ পাট,ধান ও বিভিন্ন জাতের শাকসবজি উৎপাদন করে জীবন নির্বাহ করে। আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব পূরণের জন্য নদীতে সুস্বাদু হরেক রকমের মাছ চাষ করেন। বড় বড় নদীতে পাওয়া যায় মাছের রাজা ইলিশ। যার কারণে তো এক সময় গর্ব করে বলতাম আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। আরও বলতে পারতাম বারশত নদীর দেশ বাংলাদেশ। ফলে এ দেশের মানুষের সাথে নদ-নদীর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় নদীর গুলোর চেহারা খালে পরিনত হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন নদীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশের নদী ধ্বংসের আয়োজন কবে বন্ধ হবে? নদী প্রাকৃতিক সম্পদ। ফলে কোনো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করে যত উন্নয়নের মডেল তৈরী করা হোক না কেন তা প্রকৃতির ধ্বংসাত্বক কার্যক্রমে তা নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের নানারকম কর্মকাণ্ডে নদী গুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে। অন্য দিকে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রও একতরফা ভাবে নদীতে বাঁধ দিয়ে পানিকে আটকে রাখে। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আছে দেশের ভিতরে ও বাইরের দেশে নদীকে এভাবে নির্যাতন করে থাকে তাহলে নদী বাঁচবে কেমন করে? নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে কারণ নদীর নিদিষ্ট গতিপথ থাকে। সেই পথ যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে নদীর পানি চলবে কিভাবে? তাই তো হঠাৎ বন্যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ফসলি জমি পানিতে প্লাবিত হয়ে খাদ্যসংকট দেখা যায়। খাদ্যসংকট কিংবা দেশের সংকট হোক তা যেন দেখার কেউ নেই। সবাই ছুটছে ক্ষমতার পেছনে। প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে তেমন বিস্তর বিশ্লেষণ কিংবা আলোচনা করা সময় নেই। ফলে একদিকে মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে চরম হাহুতাশে জীবনযাপন করছে। আর অন্য দিকে ভালো নেই তিস্তার পাড়ের মানুষ। আর তিস্তার নদীর উপনদী গুলোকে হত্যা করার মত অবস্থা তৈরী করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ প্রায় ১১৫ কিলোমিটার। এই ১১৫ কিলোমিটারের মধ্যে তিস্তার উপনদীগুলো হচ্ছে বুড়িতিস্তা (নীলফামারী), সতী, সানিয়াজান, পানাকুড়ি, কোটেশ্বর, বুড়িতিস্তা (রাজারহাট) ও কালীবাড়ি শাখানদীগুলো হচ্ছে বাইশাডারা, ঘাঘট, মানাস, বুড়িতিস্তা। ফলে এসব শাখা নদী গুলো বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পরিচর্যা না করার ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায় তিস্তার পানিবণ্টন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর ১৯৮৩ সালে ২ বছরের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন একটি চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্য ছিল ৩৬ শতাংশ, ভারতের জন্য ৩৯ শতাংশ এবং তিস্তার নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ২৫ শতাংশ পানি রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।১৯৮৭ সালের পর তিস্তা নিয়ে আর কোনো চুক্তি হয়নি। কবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে তা অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে? আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চার দিনের জন্য ভারত সফরে গিয়েছেন। বাংলার মানুষ ধারণা করেছিল আগামী হয়তো জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিটি সই করে ফেলবে দুই দেশ। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো সূচি নেই। আশঙ্কা জায়গা বেড়েছে। তিস্তার পাড়ের মানুষের স্বপ্নের কাঙ্খিত পানিবণ্টন চুক্তি কবে হবে? তাযেন এক অদৃশ্য শক্তি চেপে ধরে আছে। ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণীত হয়েছে। ওই বছর থেকে দিবসটি ‘নদী অধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দুঃখজনক বিষয়, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার সেই আইনটিতে অনুসমর্থন করেনি। ফলে জাতিসংঘে বাংলাদেশ যে অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানাবে, তার কোনো ক্ষেত্রেও প্রস্তুত হয়নি। তিস্তা নদীকে ঘিরে সরকারের নাকি মহাপরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এ মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করার আগে নদীতীরবর্তী মানুষের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে কি তার সঠিক জবাব নেই। কবে সেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে? স্বাধীনতার ৫১ বছরে নদী বাঁচাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কি? এত বছরে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু নদী ও তিস্তা পাড়ের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। যেটা ঘটেছে দিনের পর দিন নদী বিলীন হয়েছে। মানুষের সংকট তীব্র হয়েছে।নির্বাচনের আগে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসাবে জনগণের কাছে নদী রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দাদা বাবুদের ওপর প্রতিবাদ করার সাহস থাকে না। মা যেমন বুকের দুধের প্রবাহ দিয়ে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের নদনদী বুকের দুগ্ধ-সম জলধারা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের সন্তান, এদেশের জনগণকে। গবেষকদের জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪৮ বছরে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক নদী শুকিয়ে গেছে কিংবা মরে গেছে। আর সরকারি তথ্যমতে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০। বর্তমানে এ তা দাঁড়িয়েছে ৪০৫-এ। আর বেসরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ২৩০। কোন পথে যাচ্ছে দেশ? আমাদের নদীগুলো কেন হারিয়ে যাচ্ছি? সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। এতে বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদার ভুয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও চালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ কতটুকু কার্যকর? রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃতি, জলাভূমি, বনভূমি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয় নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নদী দখল করে রাখে। আমাদের দেশে নীতি, আইন,পরিসংখ্যান সব আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। নদীকে ধ্বংস করে দেশের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা যাবে না। আমরা হাজার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারব কিন্তু একটি নদীও সৃষ্টি করার সামর্থ্য কারও নেই। ফলে নদী ধ্বংসের আয়োজন থেকে দূরে আসতে হবে। অভিন্ন ৫৪ টি নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদী অমিমাংসিত ইস্যু। দু'দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে একমাত্র গঙ্গা নদীর পানির বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি কেন? ভারত তিস্তা নদীতে বাংলাদেশের উজানে গজল ডোবায় ব্যারেজ নির্মাণ করে তিস্তার পানি অনৈতিক ও একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে। এর ফলে উত্তরবঙ্গের জেলা গুলো কৃষি হুমকির মুখে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এর জন্য উত্তরবঙ্গ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখী। শুধু তিস্তা নয়, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামে বাঁধের মালায় বাংলাদেশকে ঘিরে ফেললে তা বাংলাদেশের প্রাণ, প্রকৃতি,পরিবেশ ভয়ংকর ঝুঁকিতে ফেলবে। ইতোমধ্যে ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবনাক্ততা এবং রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ ঘটে চলছে। এতে প্রতিবছর লাখ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের। কিন্তু সরকারের নতজানু হয়ে থাকে কেন? আমরা কি পানির ন্যায্য অধিকার পাব না? বাংলাদেশ নদী ও পানির দেশ। পানির প্রবাহ বন্ধ হলে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাই নদী গুলোর প্রতি বিশেষ যত্ম নিতে হবে। শুধু সম্পদ আহরণ করলে চলবে না। কে নদী দখল করে নিয়েছেন, কে নদী দূষণ করছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ওয়াসা থেকেও প্রতিদিন নদীতে ময়লা ফেলতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। নদী রক্ষায় সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। আমাদের যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে সেই সরকারের উচিত বাংলাদেশের নদনদী রক্ষার ইস্যুটি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করা। পদ্মা, তিস্তাসহ সকল নদ-নদীতে ভারত সীমান্ত ঘেঁষে বাঁধ নির্মাণ করা যাতে বন্যার সময়ে পানি আটকিয়ে দিয়ে অন্তত বন্যার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়। নদী বিপন্ন করে মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে রাখে রাষ্ট্রের উচিত নয়। কারণ নদী হচ্ছে পৃথিবীর ধমনীর মতো। এর প্রবাহমনতাই সত্যিকার অর্থে আমাদের জীবন রক্ষাকারী। তাই নদী বাঁচলে, মানুষ বাঁচবে আর মানুষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট । |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |