খনিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার কবে নিশ্চিত হবে
রাশেদুজ্জামান রাশেদ
|
রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেই দায়িত্ব নিয়েও জনগণের প্রশ্ন রাষ্ট্র কী নিরাপত্তায় রেখেছেন? আবার নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব রাষ্ট্রের সম্পদের সুরক্ষা করা। সেটা নিয়েও মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ওঠে। যে সকল নাগরিক রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করে তারা রাষ্ট্রের কাছে অপরাধী। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকেন তাদের ভুলনীতি কিংবা দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি বা অপচয় হলে তাদের জন্য রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নেন? গণতান্ত্রিক দেশে অগণতান্ত্রিক চর্চা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে গিজগিজ করেছে। কখনও রিজেন্ট সাহেদের ‘কারবার’, স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় ‘মিঠু চক্রের’ বিপুল দুর্নীতি, যুবলীগের ক্যাসিনো সম্রাট-খালেদের তেলেসমাতি, নরসিংদীর পাপিয়া-কাণ্ড, ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের দিনকে রাত রাতকে দিন করার ক্ষমতাবাজির বিষয়সহ বালিশ-কাণ্ড, নারিকেল গাছ-কাণ্ড, কয়লা-কাণ্ড, লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশ-কাণ্ডসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয় দেখতে দেখতে দেশের জনগণ আজ যেন বিষিয়ে উঠেছেন। দুর্নীতিতে দেশ ভরপুর। এ যেন ডিজিটাল বাংলাদেশের সংস্কৃতি। তবে আশার আলো হচ্ছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের পর কয়লাই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিকল্প জ্বালানিভাণ্ডার। বিশ্বে মোট ব্যবহৃত জ্বালানির ২৬.৫ শতাংশ মেটায় কয়লা এবং বিশ্বে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪১.৫০ শতাংশ আসে কয়লা থেকে। আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গে অর্থাৎ দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়া, রংপুর জেলার খালাশপীর এবং জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ-এ পাঁচটি কয়লা বেসিনে এ পর্যন্ত নির্ণয় করা কয়লার পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ৩০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যার তাপ উৎপাদনক্ষমতা ৯১ টিসিএফ গ্যাস পোড়ালে যে তাপ পাওয়া যাবে প্রায় তার সমান। ১৯৬৩ সালে জয়পুরহাট জেলায় চুনাপাথর খনি আবিষ্কৃত হয়। ওই খনিতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন (১০ লাখে ১ মিলিয়ন) টন চুনাপাথর মজুদ থাকলেও আজ পর্যন্ত এক টনও উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি কেন? জয়পুরহাটের এ খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা হলে দেশের চুনাপাথরের চাহিদা পূরণ সহযোগীতা করবে আর অন্য দিকে বেচার মানুষের নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরী হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অযত্মে আর অবহেলায় পড়ে আছে এই খনিজ সম্পদ। চুনাপাথর প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৮২ সাল থেকে অদ্যাবধি দায়িত্ব পালন করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রতি মাসে তাঁদের বেতনভাতা বাবদ ব্যয় হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। তাহলে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন চলে আসে জনগণের পকেটের ট্যাক্সের টাকায় দেশ চলে কিন্তু সেই টাকা এভাবে অপচয় করা রাষ্ট্রের কি উচিত? বাংলাদেশ মিনারেল এক্সপ্লোরেশন ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ১৯৮১ সালে প্রথম ধাপে প্রকল্পের ২১টি কূপ খনন করে সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এর পর ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় ধাপে শ্যাপ্ট কনস্ট্রাকশনের (উত্তোলন পদ্ধতি) মাধ্যমে প্রতিদিন পাঁচ হাজার ৫০০ টন চুনাপাথর উত্তোলন করা যাবে। আর এই পদ্ধতিতে চুনাপাথর উত্তোলনে সে সময় সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৫৯ কোটি টাকা। এমন কথা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশি হয়েছিল। কিন্তু তহবিলের অভাবে সেই থেকে প্রকল্প এগোয়নি। কবে বাস্তবায়ন হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। আমাদের উত্তরাঞ্চলের কয়লাখনি গুলোর উন্নয়নের দিকে মনোযোগ না দিয়ে ব্যয়বহুল আমদানি করা কয়লার দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এমনি কি ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাখা হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে পার্তীপুরের কয়লা চুরি হয়ে যায় আমরা পাহাড়া দিতে পারি না। বড়পুকুরিয়ার খনি থেকে কয়লা চুরির ঘটনা গোপন থাকে কেন? ভবিষ্যৎতে আরও যে চুরি হবে না তার নিশ্চয়তা কি? বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কোটি কোটি টাকার কয়লা গায়েব করে দেয়ার সঙ্গে জড়িত চক্রটি ৫৬ কোটি টাকা মূল্যের এ পাথরের মধ্যে মূল্যবান অ্যামেলগেমেট গ্রানাইট পাথর ও শিলা খেয়ে ফেলার সঙ্গেও জড়িত ছিল এমন তথ্য প্রকাশি হয়েছে। জয়পুরহাট জেলার একমাত্র জামালগঞ্জ কয়লা খনি ১৯৬২ সালে খনিটির সন্ধান পাওয়া। জরিপ কাজ ৬৭০ মিটার থেকে ১১৬০ মিটার পর্যন্ত মাটির গভীরে ছিল।এখানকার কয়লা উত্তোলন করে গ্যাসে রূপান্তরিত করতে পারলে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করে জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব। এই খনিটি চালু করা হলে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজও বাস্তবায়ন হয় নি। অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়ার পর সরকারিভাবে প্রায় ২ দশমিক ৮৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কয়লা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার পরও অবহেলায় পড়ে আছে। বিশেজ্ঞদের তথ্য মতে,সাধারণত কয়লাস্তরের অবস্থান যদি মাটির ১২০ থেকে ১৫০ মিটার গভীরে হয় এবং কয়লাস্তরটির ওপরে যদি কোনো পানিবাহী স্তর, জনবসতি বা উর্বর আবাদি জমি না থাকে, তাহলে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি প্রয়োগ করে অর্থাৎ কয়লাস্তরের ওপর থেকে সব মাটি ও পাথর সরিয়ে কয়লা তোলা হয়। আর কয়লাস্তরের অবস্থান যদি মাটির ১২০ থেকে ১৫০ মিটারের নিচে হয় এবং কয়লাস্তরগুলো যদি আঞ্চলিক পানিবাহী স্তরের নিচে অবস্থান করে, তাহলে ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতি প্রয়োগ করে কয়লা আহরণ করা হয়। সুতরাং বলা যায় অবস্থানভেদে ভূগর্ভস্থ কয়লা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি ও ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতিতে খনন করা যায়। আমাদের দেশে আবিষ্কৃত কয়লাক্ষেত্রের কয়লাস্তর বিশাল আঞ্চলিক পানিবাহী স্তরের নিচে, যার ঠিক ওপরেই রয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম, হাটবাজারসহ উর্বর আবাদি জমি। ফলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনন সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেও উচিত হবে না। এমন কি পৃথিবীর কোথাও ঘনবসতিপূর্ণ ও উর্বর আবাদি জায়গায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা তোলার নজির নেই। দুর্নীতির কারণে দেশের বিভিন্ন সেক্টর থেকে জাতীয় সম্পদ লোপাট হয়ে যাচ্ছে, এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এর ফলে দেশের উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে সমাজের মুষ্টিমেয় লোকের হাতে অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ এসে পড়ছে। সেটা করোনাকালীন সময়ে ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব অর্থের বেশিরভাগই আসছে দুর্নীতি থেকে। এর ফলে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। কাজেই দুর্নীতি রোধে সরকারের কঠোর হওয়া প্রয়োজন। যারা জাতীয় সম্পদ চুরি করেছে তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতেই হবে। আমাদের দেশের খনিজসম্পদের সন্ধান পাওয়া জায়গা গুলোকে যথাযথভাবে আহরণ ও ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে, তাতে সন্দেহ নেই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জবাবদিহি আদায়ে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে কোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। দেশের জাতীয় সম্পদ সবার তাই রক্ষা করার দায়িত্বও সবার। ফলে রাষ্ট্রের উচিত জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খনিজ সম্পদ উত্তলন করা। লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট । |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |