মেঘনায় তেলবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা
মো. জিল্লুর রহমান :
|
ভোলায় ডুবে যাওয়া জাহাজের তেল ছড়িয়ে পড়ছে মেঘনার বিস্তীর্ণ এলাকায়। তেলের ঝাঁজালো গন্ধের কারণে জেলেরা নদী থেকে মাছ শিকার করতে পারছে না। তেল ছড়িয়ে পড়ায় মেঘনার বিশাল একটা এলাকার পানি দূষিত হয়ে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশ কর্মীরা। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ ভোর চারটার দিকে ভোলার সদর উপজেলার তুলাতুলির কাছে মেঘনা নদীতে চট্টগ্রাম থেকে তেল নিয়ে চাঁদপুরে যাওয়ার পথে পিছন দিক থেকে আসা অপর একটি জাহাজ ঘন কুয়াশার কবলে পড়ে লাইটার জাহাজ সাগর নন্দিনী-২ কে সজোরে ধাক্কা দেয় এবং এতে জাহাজটি নদীতে ডুবে যায়। এতে তেলবাহী জাহাজটির পিছনের ইঞ্জিন রুমের কাছে ছিদ্র হয়ে পানি প্রবেশ করে আংশিক ডুবে গেলে জাহাজে থাকা লোকজন চিৎকার করলে একটি বালুবাহী ট্রলার এসে তাদের উদ্ধার করে। জাহাজটিতে থাকা ১১ লাখ ৩৪ হাজার লিটার অকটেন ও ডিজেলের অনেকটাই ছড়িয়ে পড়েছে মেঘনায়। এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলেরা। ভাসমান তেলের কারণে তারা নৌকা ও জাল নিয়ে নদীতে টিকতে পারছে না। ডুবে যাওয়া জাহাজটির আশেপাশের এলাকার বহু জেলের মাছ শিকার বন্ধ রয়েছে। তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে নদীতীরের গ্রামগুলোতেও। এতে স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশ কর্মীরা পরিবেশ, প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন।
বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার পর থেকেই কোস্ট গার্ডের একটি দল নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণে কাজ করছে। তবে জাহাজটিতে অক্ষত ট্যাংকারগুলোতে থাকা তেল কোনোভাবে বেরিয়ে আসলে নদীর জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে। আবার জাহাজটি ওপরে না ওঠানোর কারণে ঠিক কী পরিমাণ নদীতে ছড়িয়ে সে সম্পর্কেও কার্যত কোনো ধারণা করতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি জোয়ার ভাটার কারণে জাহাজ থেকে বেরিয়ে পড়া তেল দ্রুতই সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে। ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই মূহুর্তে ইলিশের চারটি প্রজনন ক্ষেত্র এবং ছয়টি অভয়াশ্রম আছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও এর অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলায় মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা এবং তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা অন্যতম। বিবিসির প্রতিবেদন আরও বলছে, ভোলাকে ঘিরে থাকা নদীগুলো বিশেষ করে মেঘনার প্রায় সর্বত্রই ইলিশের বিচরণ থাকে। যদিও এখন মাছের মৌসুম নয় তারপরেও এটি ইলিশের মূল বিচরণক্ষেত্র। ওয়ার্ল্ড ফিশের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে এবং উৎপাদনের হিসেবে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে ভোলা থেকেই বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। গত অর্থবছরেই এ অঞ্চল থেকে প্রায় এক লাখ নব্বই হাজার টন ইলিশ পাওয়া গেছে। ভোলা একটি দ্বীপজেলা হলেও এর চারদিকেই নদী। তবে মূলত ভোলার উত্তর ও পূর্বে দিকেই বিস্তৃত মেঘনা নদী এবং উভয় নদীই গিয়ে মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। আবার বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে মেঘনা অববাহিকাতেই ইলিশের উপস্থিতি বেশি, কারণ তাদের দরকারি খাদ্য উদ্ভিদ ও পানিকণা নদী ও মোহনাতেই বেশি থাকে। তাদের মতে, পদ্মা নদী থেকে বাংলাদেশের ইলিশের উৎপাদনের মাত্র দুই শতাংশ আসে। এছাড়া বড় ও স্বাদের ইলিশ বেশিরভাগই মেঘনা অববাহিকা থেকে আসে। আবার মেঘনায় সারা বছরই বিপুল পরিমাণ উদ্ভিদকণা ভেসে বেড়ায় ও মেঘনা দিয়ে সাগরের দিকে চলে যায়। এ কারণে ইলিশের দল খাবারের জন্য মেঘনা মোহনায় বছর জুড়েই ঘুরে বেড়ায়। এসব কারণেই তেল পানিতে বেশি ছড়িয়ে পড়লে মাছের জন্য বিপর্যয় হতে পারে বলে আশংকা করছেন অনেকে। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন তেলের কারণে মাছের ডিম ও খাবারের বিশাল ক্ষতি হবে এবং সে কারণে দ্রুত তেল অপসারণের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। জোয়ার ভাটার কারণে তেল এক জায়গায় স্থির থাকে না। অনেক তেল সমুদ্রেও চলে গেছে। ঘটনার পরদিনই কিছু মাছ অস্বাভাবিক বেশি ধরা পড়েছে। নদীতে তেল বেশি ছড়ালে মাছের ডিম ও খাবার ক্ষতির শিকার হবে। বাংলাদেশের নদীতে তেল ও পণ্যবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনা নতুন নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনিতেই সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকার জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ চরম হুমকির সম্মুখীন। তার ওপর কিছুদিন পরপর জাহাজ ডুবির ঘটনা উদ্বেগ উৎকন্ঠা বাড়াচ্ছে পরিবেশবাদী গ্রুপ ও সচেতন মানুষকে। জানা যায় ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর সুন্দরবন এলাকার হাড়বাড়িয়া ৯ নম্বর এলাকায় অবস্থানরত এমভি এলিনাবি নামক বিদেশি জাহাজ থেকে ৬০০ টন কয়লা লোড করে ঢাকার উদ্দ্যেশে ছেড়ে যাওয়ার পথে অপর একটি বিদেশী জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে জাহাজটি ডুবে যায়। এর আগে বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা বন্দরের ফেয়ারওয়ে বয়া দুবলার এলাকায় ৯ অক্টোবর, ২০২১ রাতে ১২০০ মেট্রিক টন পাথর নিয়ে এমভি বিউটি অব লোহাগড়া-২ নামে একটি লাইটার কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে। তারও আগে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ৩০ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার ৪০০ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই এমভি ইফসিয়া মাহিন নামক একটি লাইটার কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে। এছাড়া, মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাতে কয়লা বোঝাই জাহাজ এমভি বিবি-১১৪৮ ডুবে যায়। জাহাজের ভেতরে থাকা প্রায় ৭৫০ মেট্রিক টন কয়লা নদীর পানিতে মিশে গেছে। একের পর এক এসব কার্গো জাহাজ ডুবির ঘটনায় আবারো হুমকির মুখে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। আসলে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীতে জাহাজ ডুবির ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। গত ১০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে প্রাণী বৈচিত্র্য ভরপুর বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সুন্দরবনের নদীতে তলা ফেটে এক ডজনের বেশি পণ্যবোঝাই লাইটার জাহাজ ডুবেছে। ডুবে যাওয়া এসব জাহাজে থাকা ফার্নেস অয়েল, সার, কয়লা, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ক্লিঙ্কার, স্লাগ, জিপসান ছড়িয়ে পড়ছে। এসব বিষাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের নদী তীরবর্তী এলাকার প্রাণিকুল, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা একের পর এক এসব জাহাজ ডুবির ঘটনায় জলজ, বনজ ও প্রাণীজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের মতে, “তেল, সার ও কয়লা ভর্তি জাহাজ ডুবির ঘটনা পরিবেশ, প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্যর জন্যে মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। কয়লা, সার, তেল ইত্যাদি যেহেতু রাসায়নিক বিষ এবং ক্ষতিকর পদার্থ, তাই এগুলো জলজপ্রাণির প্রজনন থেকে শুরু খাদ্যচক্রে বিরুপ প্রভাব ফেলছে। প্রতিনিয়ত কয়লা, তেল, সার ভর্তি জাহাজ ডুবলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।” ভোলা জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মনপুরা উপজেলা। এ উপজেলা ইতিমধ্যে পর্যটন এলাকা হিসেবে সারা দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে এবং প্রতি বছর দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক এ দ্বীপটি ভ্রমনে আসে। তাছাড়া মনপুরার পশ্চিমে নতুন জাগা সোনাচর, পূর্বে নিঝুম দ্বীপ ও হাতিয়া, দক্ষিণে চর সাকুচি, চর নিজাম, ঢাল চর, দক্ষিণ পশ্চিমে চর কুকরী মুকরীতে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ম্যানগ্রোভ বনসহ প্রাকৃতিক নানা সম্পদে ভরপুর, যা যে কাউকে সহজে আকৃষ্ট করে নেয়। মনপুরা বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মনপুরা উপজেলায় তিনটি বিটে ৩০ হাজার একর জমিতে বনায়ন করা হয়েছে। এসব বনে কেওড়া, বাইন, সুন্দরী, কাকরা, গেওয়া, করমচা, গোলপাতাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। এই বনে হরিণ, বন্য মহিষসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশু ও পাখি রয়েছে। এই বন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করে আসছে। এসব এলাকার সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের দৃষ্টিনন্দন ম্যানগ্রোভ বন যেমন যুগ যুগ ধরে ঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে এ দ্বীপের মানুষকে আগলে রেখেছে, তেমনি এ বনে রয়েছে মায়াবী হরিণসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। আসলে ম্যানগ্রোভ বনের সবুজ বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা মনপুরা উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। ১৯৭০ সালের বন্যায় এ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। এর পর থেকেই এখানে গড়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন ম্যানগ্রোভ বন। কিন্তু তেলবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনায় হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দিয়েছে এখানকার পরিবেশ, প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্য। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা নদীতে একের পর এক জাহাজ ডুবির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ ও বেপরোয়া জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রন না করায় নদ-নদী এখন ডুবন্ত জাহাজের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এত করে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী গাছের শ্বাসমূলসহ জীববৈচিত্র্য ও কয়েক শত প্রজাতির মাছসহ জলজ-প্রাণির প্রজননে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী সবুজ বেষ্টনী অঞ্চল এমনিতেই জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। গবেষকরা বলছেন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার অন্যতম শক্তি এসব ম্যানগ্রোভ বন। সিডর, আইলা ও বুলবুলের সময় এসব ম্যানগ্রোভ মানববর্মনের ন্যায় রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করেছে অথচ মানব সৃষ্ট কিছু বিপর্যয় ও অবহেলার কারণে এসব প্রাণিকুল ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। এসব কারণে তেলবাহী জাহাজটি দ্রুত উদ্ধার কিংবা জাহাজে থাকা জ্বালানি তেল অপসারণ না করা হলে ইলিশ মাছের অভয়ারণ্যের ব্যাপক ক্ষতির আশংকা রয়েছে। একই সাথে প্রাণিকুল, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট । |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |