সাম্রাজ্যবাদ কলম্বাস ও ভাস্কো ডা গামা
ইলিয়াজ হোসেন রানা
|
![]() . ১৩০৪ সালে ইউরোপে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার ফলে পুরো ইউরোপের এক- তৃতীয়াংশ বসতি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে ইউরোপ তখন নতুন বাজার তলাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ইউরোপের সমস্ত রাষ্ট্র যাদের মধ্যে পর্তুগাল, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও ব্রিটেন অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারা ব্যবসার জন্য বের হয়। তখন আর্ড রাউফ ক্রাইস্ট নামক খ্রিস্টান টেম্পলার সংস্থা এই কাজে অক্লান্তভাবে নিরত থাকে; পর্তুগাল এবং স্পেনের শাসকেরা এই ধরনের উদ্যোগে বিশেষভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে। সেই সময় স্পেনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রানী ইসাবেলা, দুজনের প্রবল বাসনা মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে তারা সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে। আর সেই বাসনা থেকে নতুন সামুদ্রিক পথ খুঁজে বের করবার উদ্যোগেও তারা এগিয়ে আসে। গ্রানাডা দখলের অব্যবহিতকাল পরেই আগস্ট ১৪৯২ সালে বিখ্যাত নৌ- অভিযাত্রিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে প্রাচ্য অভিমুখী পথ আবিষ্কারের জন্য যাত্রা করিয়ে দেয়। কলম্বাস আটলান্টিকের পশ্চিম উপকূল দিয়ে অভিযাত্রায় বের হন এবং দুটো নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করেন, যা তখনও পর্যন্ত ইউরোপীয়দের কাছে অজানাই ছিল। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পরে ইউরোপীয়রা ঘনঘনই আমেরিকায় অভিযান পরিচালনা শুরু করে। যেহেতু কলম্বাসের আমেরিকা অভিযানের খরচ স্পেন দিয়েছিল, তাই আমেরিকা থেকে প্রথম যে সম্পদের পাহাড়টি এসেছিল তার সবটুকু স্পেনেই যায়। আর স্পেন সেগুলো পেয়ে কিছু সময়ের জন্য ইউরোপের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। স্পেন আমেরিকা থেকে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ নিয়ে এসে নিজেদের দেশে ইচ্ছে মতো ব্যয় করছে। ফলে ইউরোপের স্বর্ণবাজার পুরোপুরি ধ্বসে যায় আর সেই ধ্বসের কারণেই স্পেনের অর্থনীতিও ভগ্নদশায় নিমজ্জিত হয়। ৮ জুলাই ১৪৯৭ সালে পর্তুগালের ভাস্কো ডা গামা নামের এক নৌ-অভিযাত্রী লিসবন বন্দর থেকে যখন যাত্রা আরম্ভ করে তখন সাম্রাজ্যবাদী এই দলকে পোপের বার্তা পাঠ করে শুনানো হয়। সেই বার্তায় তাদের অনুমোদন দেয়া হয় মুসলমান এবং আফ্রিকার অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করবার। ৪ টি জাহাজের এই নৌবহরে অভিযাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৭১ জন। অনবরত তিনমাসের সফর শেষে ৬০০০ মাইল সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে তারা ডিসেম্বর মাসে আফ্রিকার এক কোনার দিকের জনপদ কেপটাউন পৌঁছে। এরপর সেখান থেকে প্রাচ্যের দিকে মোড় নেয়। সমুদ্র -পথে তাদের কাছে এ ছিল একদমই অপরিচিত এক রুট। তারা নিরপদে মোজাম্বিক পর্যন্ত পৌছে যায়। মোজাম্বিক তৎকালে মুসলিম রাজ্য ছিল। ভাস্কো ডা গামা এখানে মুসলিম বেশ ধরে মোজাম্বিকের সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং সেখানকার প্রথা অনুযায়ী সুলতানের সামনে কিছু উপঢৌকন হাজির করে। যার মধ্যে ছিল তামার তৈজসপত্র, টিনের ঘন্টা এবং সূতি কাপড়। সুলতান এসব জিনিস দেখে অসন্তুষ্ট হন। কারণ পণ্যগুলোর মান ইসলামি দুনিয়ার বিচারে ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। ভাস্কো ডা গামা বাণিজ্যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ফিরবার কালে মোজাম্বিকের উপকূলে গোলা নিক্ষেপ করতে করতে পলায়ন করে। পলায়ন কালে তারা আরবের বাণিজ্যিক জাহাজ দেখতে পায়। জাহাজগুলোতে কোন ধরনের নিরাপত্তাকর্মী কিম্বা অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় ভাস্কো ডা গামা জাহাজে লুটতরাজ চালায় এবং একইসাথে পর্তুগীজদের এ ধারণাও পোক্তভাবে তৈরি হয় যে, সমুদ্রে মুসলমানদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। তাদের উপর লুটতরাজ করা কঠিন কোন কাজ নয়। ফেব্রুয়ারি ১৪৯৮ সালে সাম্রাজ্যবাদের এই প্রথম দলটি কেনিয়ার বন্দরনগরী মালিন্ডিতে পৌঁছায়। এখানে ভাস্কো ডা গামার সাথে কিছু হিন্দু নাবিকের সাক্ষাত হয়। ভাস্কো ডা গামা তাদের খ্রিস্টান মনে করে এবং বন্ধুত্ব করে নেয়। ঐ হিন্দু নাবিকেরাই পর্তুগীজ দস্যুদের পথ দেখিয়ে হিন্দুস্তান নিয়ে আসে। ১৮ মে ১৪৯৮ সালে সাম্রাজ্যবাদী এই পর্তুগীজ কাফেলা হিন্দুস্তানের বন্দরনগরী কালিকটের উপকূলে নোঙর ফেলে। ভারতবর্ষে তখনও মোগলসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি এমনকি দিল্লির মুসলমান শাসকদের সমুদ্র উপকূলে কোন প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরি হয় নি। কালিকট এবং উপকূলীয় অধিকাংশ রাজ্য স্বায়ত্তশাসিত ছিল। ভাস্কো ডা গামা কালিকট রাজার মন জয় করার জন্য কাঁচের মালা, মধু এবং সূতিকাপড় উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করে, যা দেখে একজন আরব বণিক বলে ওঠেন রাজা এই বর্জ্য কখনোই গ্রহণ করবেন না। রাজা, ভাস্কো ডা গামার উপঢৌকন দেখে সন্তোষ হন নি।ফলে তার এ অভিযান ব্যর্থ হয়। হিন্দুস্তানে তিন মাস থাকার পরে ভাস্কো ডা গামা ভগ্নমনোরথ নিয়ে পর্তুগালে ফিরে আসে এবং এটা পুরোপুরি নিশ্চিত হয় যে, আফ্রিকা এবং হিন্দুস্তানের সমুদ্র পথের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। ১৫০২ সালে ভাস্কো ডা গামা দ্বিতীয়বার পূর্ণ রণসজ্জিত হয়ে নৌবহর নিয়ে হিন্দুস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পথিমধ্যে মোজাম্বিক এবং তানজানিয়ায় নেমে লুটতরাজ চালায় এবং নির্বিচারে মুসলমানদের রক্ত প্রবাহিত করে। হিন্দুস্তানে পৌঁছে সে গোয়ার একটি শহরে হামলা করে এবং তাকে নিজের খাজনা আদায়ের কুঠি হিসেবে ঘোষণা করে। কন্নৌর উপকূলে সে একটি আরব নৌযান ঘেরাও করে যাতে উমরা শেষে মক্কা থেকে প্রত্যাবর্তনকারী ৭০০ পুরুষ-নারী বৃদ্ধ এবং শিশু যাত্রী ছিল। ভাস্কো ডা গামা জাহাজের সমূদয় সম্পদ লুণ্ঠনের পর তীর্থ যাত্রীদের একটা ঘরে আবদ্ধ করে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়, মুহূর্তে জাহাজের যাত্রীরা জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। ভাস্কো ডা গামা অতি দ্রুত কালিকট বন্দরে হামলা চালিয়ে প্রায় ২৫ জন মুসলমান ও হিন্দুকে গ্রেফতার করে। শহরের মধ্যিখানে লোকজনের ভীড়ে তাদের হাত-পা এবং নাক-কান কেটে হত্যা করে। কতক মুসলমানদের জাহাজের মাস্তুলের সাথে বেঁধে তিরন্দাজির নিশানা বানায়। এ ধরনের দৃশ্য চিত্রায়িত করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মুসলমানদের হাতে তাদের পরাজয়ের ক্ষোভ মেটাচ্ছিল কেবল নয়; বরং এসবের মাধ্যমে তারা শুরু থেকেই দুনিয়াজুড়ে ত্রাস ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। হিন্দুস্তানের ব্যাপারে পর্তুগীজদের অনুমান ছিল সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ট অধিবাসী খ্রিস্টান, যাদের সাথে হাত মিলিয়ে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে নেওয়া যাবে-তা শুরুতেই সম্পূর্ণভাবে ভুল প্রমাণিত হয়। তদুপরি ভাস্কো ডা গামার অভিযানের ফলে ইউরোপের সামনে বাণিজ্যের নতুন পথ উন্মোচিত হয় এবং লুটতরাজ চালানোর জন্য তারা একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র পেয়ে যায়। আর এভাবেই ইউরোপের উপর তুর্কির বাণিজ্যিক অবরোধ বিফল হয়ে দেখা দেয়। ওদিকে কলম্বাসের অভিযান ইউরোপকে ধনসম্পদে পরিপূর্ণ এক নতুন দুনিয়ায় সন্ধান দেয়। ফলে ইউরোপে সচ্ছলতার জোয়ার দেখা দেয় । যদিও ইউরোপের সচ্ছলতা ও স্বাবলম্বিতার যে ইমারত, তা গড়ে উঠেছিল অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানুষের অস্থিমজ্জার উপর। লেখক: প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা। ডেল্টা টাইমস্/ইলিয়াজ হোসেন রানা/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |