বিজ্ঞানভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি চালু করতে হবে
রাশেদুজ্জামান রাশেদ
|
শিক্ষা সমাজের কুসংস্কার দূর করে আলোর পথ দেখায়। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যতিত আলোর পথ দেখা মানে হচ্ছে আকাশ কুসুম চিন্তা করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় শাসক শ্রেণি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করে শিক্ষার আয়োজন সংকোচন করে। অপর দিকে শোষণ যন্ত্র চালু রাখে। বিট্রিশ বেনিয়াদের এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে দেখেছি শিক্ষা সংকোচ করতে। সমাজ বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় 'ভাগ কর, শাসন কর।' অর্থাৎ সমাজের মানুষের মধ্যে যতরকমের ভেদাভেদ তৈরী করা যায়। ঠিক ততই শাসন ও শোষণ করা সম্ভব। শাসন ও শোষণ করার নীতিটা শিক্ষাখাতেও ঠিক একই রকম দেখা যায়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে যত শ্রেণিভেদ করা যায় ততই শাসকের উপকার। অন্য দিকে শিক্ষায় যত কম বাজেট দেওয়া যায় ঠিক ততই কম তৈরী হবে গবেষক, বিজ্ঞানী, আবিস্কারক, কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি। তাহলে শাসকের শোষণযন্ত্র বন্ধ করার কেউ থাকবে না। ফলে শাসক বুঝতে পারে এরা যত বেশি জানে তত বেশি অমান্য করে। ইতিহাসে দেখা যায়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছাত্র সমাজের আন্দোলনে আগুনের ঝলকানি দেখেছিল ১৯৬২ সালে। শাসকের শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না জানা অনেকেই। বাঙালি জাতির জন্য আরও নতুন করে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল ১৭ সেপ্টেম্বর মহান ‘শিক্ষা দিবস’। তবে কে জানে এই মহান শিক্ষা দিবসের কথা। স্কুল, কলেজের পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা জানে না “শিক্ষা দিবস” নামে একটি দিবস আছে। তারা যদি মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনের কথা বলতে পারে, তারা যদি মুক্তির সংগ্রাম মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে পারে তাহলে শিক্ষা দিবস সম্পর্কে জানেন না কেন? শিক্ষার্থীদের ইতিহাস জানার দায়িত্ব কার? শিক্ষা দিবস কেন পালন করা হয়? কি ঘটেছিল এই দিনে? কেন শিক্ষা দিবসকে ভুলানো উচিত নয়? প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানতে হবে। তারপর শিক্ষা রক্ষার আন্দোলন এবং বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রের শিক্ষা পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে যদি শিক্ষার সাংবিধানিক অধিকার যদি প্রতিষ্ঠা এখনও হয় নি। তাহলে শিক্ষার মৌলিক অধিকার আদায়ে দাবি তোলা জরুরি। আজ থেকে ৬১ বছর আগে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া ‘শরীফ কমিশনে’র শিক্ষানীতি প্রতিহত করতে গড়ে উঠেছিল ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন। সর্বপ্রথম স্নাতক শ্রেণির ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে শরিফ কমিশনের বিরুদ্ধে। কারণ স্নাতক কোর্সকে ১ বছর বাড়িয়ে ৩ বছর করা হয়, এবং পাস করার ও প্রথম শ্রেণি পাওয়ার ন্যূনতম নম্বর বাড়িয়ে যথাক্রমে ৫০% ও ৭০% করা হয়। ক্রমান্বয়ে এ আন্দোলনে সাধারণ ছাত্ররা যোগ দেয় ও জনসাধারণ এতে সমর্থন যোগায়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী শিক্ষা সংকোচনমূলক নীতির প্রতিবাদে এবং একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিন এটি। শিক্ষা দিবসের ইতিহাস কেন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরা হয় না? যারা শিক্ষার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে রাজপথে রক্ত ঝরালেন তাদের রক্তের কি মূল্য নেই? শিক্ষা দিবস পালন করতে গিয়ে কেন পুলিশী আক্রমণের শিকার হতে হয়? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে যতগুলো সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের ছাত্রসংগঠন শিক্ষা দিবস পালনের বাঁধা দিয়েছে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করে আমরা পেয়েছি একটি মানচিত্র, স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি লাল-সবুজের পতাকা। পেয়েছি একটি শিক্ষা দিবস। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ দিবসটি এখন বাম প্রগতিশীলরা ছাড়া কেউ মনে রাখে না। এমন কি রাষ্ট্রীয় ভাবে দিবস টি পালন করা হয় না। যে জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যে যত বেশি উন্নত সেই জাতি শিক্ষায় তত বেশি উন্নত। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা বিতরণ করে না, শিক্ষার সৃষ্টি করে। আর উন্নত গবেষণার মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণাই নেই। তাহলে শিক্ষার মান বাড়বে কীভাবে? তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আলাদা করে বলতে হয়। শিক্ষার সংকটের কারণে এখানকার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন হতাশায় নিমজ্জিত। দেশের প্রতিটি স্তর সংকটে ভরপুর, এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট যেন তলানিতে পড়ে আছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বছরে কয় দিন ক্লাস পান? তাঁদের শিক্ষার আয়োজন কতটুকু থাকে? স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আটটি শিক্ষা কমিশন বা কমিটি তার প্রতিবেদন পেশ করে। ১৯৭৪ সালে ড. কুদরাত-ই-খুদা কমিশন, ১৯৭৯ সালে কাজী জাফর অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি, ১৯৮২-৮৩ সালে ড. মজিদ খানের শিক্ষানীতি, ১৯৮৭ সালে মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ২০০০ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতি, ২০০৩ সালে ড. মনিরুজ্জামান মিয়ার জাতীয় শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন, ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতি ঘোষিত হয়। এ শিক্ষা নীতি প্রণীত হয়েছিল এখনকার সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় সে নীতির সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এ শিক্ষানীতিতেও ১৯৬৯ সালে প্রণীত ছাত্র সমাজের ১১ দফা, ১৯৮৩ ও ১৯৮৭ সালের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ দফা, ১৯৯০ সালের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০ দফার মৌলিক দাবি আজও পূরণ হয়নি। ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষের আগে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। প্রাথমিক-মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে বাংলাদেশের সকল নাগরিককে একই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার সর্বজনীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার বদলে মাদ্রাসা আরবি মাধ্যম, সাধারণ বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ইত্যাদি বিভিন্ন ধারার বৈষম্যমূলক শিক্ষার অপ্রতিহত প্রসার ঘটছে। এ সব বৈষম্য দূর করার বদলে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের তোয়াজ করার নীতি গ্রহণ করে বাংলা মূলধারার সাধারণ শিক্ষায় ধর্মীয় উপাদান যোগ করতে গিয়ে একে অবৈজ্ঞানিক কুসংস্করাচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক পাঠ্যে রূপান্তর করা হচ্ছে। ফলে বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য যুক্তিবাদী শিক্ষা পাঠ্যক্রম গড়ে তোলার বদলে ধর্মীয় গোঁড়ামী ও উগ্রবাদীদের উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে শিক্ষা পাঠ্যক্রম। শিক্ষা দিবসের চেতনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি চালু করতে হবে। শিক্ষা দিবস কে রাষ্ট্রীয় পালনের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাখাতে ইউনেস্কোর অনুযায়ী মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিক্ষা খাতে বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ ধারায় রাজনীতি ফিরে আনতে হবে। লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট । ডেল্টা টাইমস/রাশেদুজ্জামান রাশেদ/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |