রোববার ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

কিম-পুতিন-ব্লোফেল্ডের সাক্ষাৎকার কি বার্তা দিল
রায়হান আহমেদ তপাদার
প্রকাশ: শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ২:২৬ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

.

.

আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করি, যেখানে ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রধানত আগ্রাসী শক্তিকে সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে নিবৃত্ত রাখার ওপর নির্ভর করে বলে মনে করা হয়। অনেক সময় ভয়ডর দেখিয়ে এক শক্তি অপর শক্তিকে বাধা দান করে থাকে। কিন্তু এই সামরিক চাপ বা ভয়ডর দেখানোই যে বৈশ্বিক ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা ধরে রাখে, তা প্রমাণ করব কেমন করে?

ইউরোপে চলমান যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। ২০২১ সালের জানুয়ারির শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে সাবধান করে বলেছিলেন, পুতিন যদি ইউক্রেনে হামলা করেন, তাহলে রাশিয়ার ওপর আরও কঠিন অবরোধ আরোপ করা হবে, যা মস্কোর জন্য মোটেও ভালো হবে না। কিন্তু পুতিন সে ভয়ডরকে পাত্তা দেননি। এরপর যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপিয়ান মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তা দিয়ে রাশিয়াকে অধিকতর ভয়ডর দেখিয়ে তাকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। পুতিন এমন একজন নেতা, যিনি গত কয়েক বছরে যা কিছু করেছেন, তার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া এখনো সুপার পাওয়ার এবং দেশটিকে ভয় ও সম্ভ্রমের চোখে দেখতে হবে-এই বার্তা দেওয়া। তাঁর এমন বৈঠক রীতিমতো অপমানজনক। কিম-পুতিনের আলিঙ্গন মনে করায় যে সমরাস্ত্রের জন্য রাশিয়ার কাছে এখনো বিকল্প আছে। কিন্তু বিকল্পগুলোও দুর্বল, যেমন উত্তর কোরিয়া ও ইরান।

কিম-পুতিন-ব্লোফেল্ডের এই সাক্ষাৎকারের আরেকটি দিক হলো, এ বৈঠকে চীনের নেতা সি চিন পিংকে যুক্ত করা হয়নি এবং চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান বরাবরই এড়িয়ে চলেছে। ইউক্রেনে গত ফেব্রুয়ারিতে পুতিনের আগ্রাসনের পর চীন-রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ে। কিন্তু এর মধ্যে সামরিক পণ্য কেনাবেচার কোনো ব্যাপার ছিল না।  

তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০২২-এ পুতিনের ইউক্রেন দখলের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে রাশিয়ার নেতারা বেইজিংয়ে যান এবং একটি দীর্ঘ যৌথ বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিতে তাঁরা অবারিত অংশীদারত্বের প্রতিশ্রুতি দেন। ওই বিবৃতিতে তাঁরা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান ঘোষণা করেন এবং পশ্চিমা নীতি ও বৈশ্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, সেগুলোর প্রভাব নিঃশেষ করে দেওয়ার পক্ষে কথা বলেন। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটির প্রেসিডেন্ট তিনি। ঘৃণ্য এক স্বৈরশাসক। তারপরও তিনি আমাদের নজর কাড়েন। কারণ, সাঁজোয়া ট্রেনে চড়ে তিনি যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন অনেকেই তাঁর সঙ্গে মিল খুঁজে পান চটকদার খলনায়ক জেমস বন্ডের। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের জন্য এই সফর জয়সূচক। পুতিনের জন্যও এটা একটা সুযোগ, তবে অপমানও বটে। এশিয়া ও গোটা বিশ্বের জন্য এটা সিনেমার পার্শ্ব প্রদর্শনীর মতো। এই সফরের গুরুত্ব নিহিত আছে অন্য কোথাও। প্রেসিডেন্ট কিমের ছোটখাটো এই জয় মেনে নেওয়া যায়। উত্তর কোরিয়া টাকার ব্যাপারে বরাবরই বেপরোয়া। অতীতে তারা টাকা জাল বা সাইবার হামলা, কিংবা দাসত্বমূলক কাজে শ্রম সরবরাহ, অবৈধ ওষুধ উৎপাদনসহ নানা কিছু করে বৈদেশিক মুদ্রা কামিয়েছে। এই বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে তারা সমরাস্ত্র ও ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচিকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। তাই রাশিয়া প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার সমরাস্ত্র কিনতে চাইছে এবং এর জন্য এমনকি কৌশলগত সহযোগিতা দিতে চাইছে-কিমের মতো একজন বিক্রেতার কাছে এ তো স্বপ্নের মতো ক্রেতা। এতে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে ব্যাপক কোনো পরিবর্তন হবে, এমনটা বলা যায় না। যদিও খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের অস্ত্রশস্ত্র এগুলো, অন্তত যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি কিছু অস্ত্রের জোগান তো হবে।

উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন খুবই কম এবং যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে দেওয়ার মতো নয়। এই বৈঠক এটাই প্রমাণ করে যে রাশিয়ার নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন এবং জোগান এতটা কমেছে যে পুতিনকে এখন কিম জং-উনকেও তোয়াজ করতে হচ্ছে। তবে এই যে যৌথ বিবৃতিতে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক না গলানো কিংবা জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে কথা বলা হলো, তার কিছুদিন বাদেই রাশিয়া ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ করে। এর অর্থ দাঁড়ায়, চীন ও রাশিয়া যে দেশগুলোকে নিজেদের বলে দাবি করে, সেসব দেশে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তাদের আছে। ইউক্রেনের জন্য দেশটির নাম রাশিয়া আর চীনের জন্য তাইওয়ান। সেদিক থেকে দেখতে গেলে চীনের জন্য ইউক্রেন ছিল প্রক্সি ওয়ারের মতো। কিন্তু তারপরও চীন এখনো এই যুদ্ধে সরাসরি জড়ায়নি। রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির অংশীদারত্ব এখনো সীমার ভেতরেই আছে। সমরাস্ত্র বা যুদ্ধের রসদ জোগানো পর্যন্ত গড়ায়নি। ১৯৫০-৬০ সালের দিকে চীনের বদলি হিসেবে ধরা হতো উত্তর কোরিয়াকে। এমনও হতে পারত যে কিমের রাশিয়া সফরের পেছনে চীনের হাত থাকার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যেত। তবে কয়েক দশক ধরে উত্তর কোরিয়া ও চীনের মধ্যে সেই আগের সম্পর্ক আর নেই। চেয়ারম্যান মাও সেতুং যে সম্পর্ককে বলতেন ঠোঁট আর দাঁতের মধ্যকার সম্পর্ক। প্রকৃতপক্ষে, এই দুই দেশের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, কখনো কখনো শত্রুভাবাপন্ন মনে হয়। যেকোনো বিবেচনায় যদি উত্তর কোরিয়া এখন রাশিয়ায় চীনা অস্ত্র সরবরাহের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হতো, তাহলে মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারত না এর চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে নয়াদিল্লিতে। ভারত জি-২০ সম্মেলন আয়োজন করে বিশ্বের বড় বড় দেশ, ধনী-দরিদ্রদের এক মঞ্চে এনেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দিল্লি থেকে গেছেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কমিউনিস্ট শাসিত দেশ ভিয়েতনাম সফরে।

চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেননি। হয়তো তিনি তাঁর মনের মতো হয়-এমন সব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাচ্ছেন, হয়তোবা চীনা অর্থনীতি এখন সংকটের মুখোমুখি, সে কারণে তিনি এ ধরনের সম্মেলন এড়িয়ে চলছেন। চীনা রাজনীতিকেরা সম্প্রতি জাপানি সাংবাদিকদের কাছে এই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন যে সি দেশের ভেতরে কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন অর্থনীতির এই অবস্থা নিয়ে। বেপরোয়া রাশিয়া, সংকটে পড়া চীনের পাশে ভারত জি-২০ সম্মেলন করে নিজেদের অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে। আর মার্কিন কূটনীতির ফল ফলছে চীনের একেবারে নাকের ডগায়। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ভিয়েতনাম সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে তারা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এখন চীনের প্রভাববলয়ে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সম্পর্কোন্নয়নের জায়গা থেকে বাইডেন গেলেন ভিয়েতনামে। বাইডেন যা যা করেছেন, তাও একজন বিক্রেতার স্বপ্ন বলে বিবেচনা করা যায়। দুই দেশই নিজেদের মধ্যে আকর্ষণীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইতিহাস দুই কোরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক; কারণ সেখানে উত্তর কোরিয়া একদিকে পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির শর্তে বাধা পড়ে সে ধরনের কোনো অস্ত্র বানাতে পারছে না। সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরির পক্ষে। ১৮ মাসের কাছাকাছি সময় ধরে ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে পুতিন একটি মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ঘৃণিত হয়েছেন। উপহাসের মুখে পড়েছেন। নিজের সৃষ্ট দুর্দশার বিষয়ে উদাসীন থেকে পুতিন নিজেকে বিশ্বের নিকৃষ্টতম ও বিপজ্জনক আসামি করে তুলেছেন।

পুতিন আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতা ও ক্রমবর্ধমান আধ্যাত্মিক অবক্ষয়কে মূর্ত করে তুলেছেন।  প্রাচীন উপকথায় উল্লিখিত ভূত-প্রেত ও দেও-দৈত্যের মতো কর্মকাণ্ড তাঁকে ‘বৈশ্বিক ভূতে’ পরিণত করেছে। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও সারা বিশ্বে খুব কম লোকই এই ছিমছাম চেহারার সাবেক কেজিবি ঠগকে বিশ্বাস করত। লোকে তাঁকে রাশিয়ার নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা করত? অবশ্যই করত। তাঁকে সহ্য করত অথবা ভয় করত? হ্যাঁ, করত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে পুতিনের প্রশংসা করত? না, করত না। এখন পুতিন একেবারেই বন্ধুহীন হয়ে পড়েছেন। তিনি নিজেই এখন রাশিয়ার জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। পুতিনের দানবীয় ভাবমূর্তির কারণে কোনো দেশই তাঁর উপস্থিতিকে স্বাগত জানাতে পারছে না। এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে আগামী অক্টোবরে তাঁর বেইজিং সফরে যাওয়ার কথা। ধারণা করি, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পুতিনের সঙ্গে সীমাহীন অংশীদারির যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি মনে মনে অনুতাপ করে থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই বোঝা হয়ে ওঠা পুতিনের বন্ধুত্বের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন।ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বৈশ্বিক ভারসাম্য রক্ষায় শুধু ঝুঁকি কমানোটাই সব সময় যথেষ্ট হয় না, বরং প্রায়ই ঝুঁকি হ্রাসের মাত্রাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পুতিন সম্ভবত একটি ক্ষীণ পশ্চিমা জোটের ওপর নির্ভর করে বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁর বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা গুলো ব্যর্থ হবে।তবে তিনি এখন পর্যন্ত ন্যাটো দেশগুলোর সরবরাহ লাইনে আঘাত করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন এবং পশ্চিমারা পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি সত্ত্বেও ইউক্রেনকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তারা ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা অথবা আধুনিক যুদ্ধবিমান দেওয়ার বিষয়ে এখনো অনিচ্ছুক। হুঁশিয়ারিপূর্ণ বাধাদানকে কার্যকর করতে হলে সেই হুঁশিয়ারির বিশ্বাসযোগ্যতা থাকাটা জরুরি।


লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।


ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬১, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬১, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com