যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কৌশলগত হিসেব-নিকেশে বাংলাদেশ
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() . এখন দেখা যাচ্ছে যে কূটনৈতিক পন্থার বাইরে গিয়ে তারা প্রয়োজনে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতেও ইচ্ছুক, এবং অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র ও অধিকার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় দেশজুড়ে এখন ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অভিজ্ঞ মহলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভিসা নীতির আলোচনা চলছে। প্রশ্ন অনেক, উত্তর খুঁজছে সবাই, সংবাদ মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার খবর প্রকাশের পর বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ধরণের বিশ্লেষণ চলছে। ভিসা নীতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ভিসা বিধি-নিষেধ বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে কি-না তা নিয়ে তাদের মধ্যে একধরনের সন্দেহ কাজ করছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি জোরালো প্রতিবন্ধকতা হবে কি-না সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে তা নির্ভর করবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটের ওপর। প্রশ্ন উঠতে পারে-বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সনাতন কূটনৈতিক পন্থা ছেড়ে এমন একটি হুঁশিয়ারিমূলক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে কেন? তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে এই প্রথম কোন দেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের ভিসা নীতি নিলো তা কিন্ত নয়। অতীতে নাইজেরিয়া ও উগান্ডার মত কিছু দেশের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এটা জানানোর জন্য যে এসব দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া তারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে,এবং তাতে তারা নানা অনিয়ম দেখতে পেয়েছে।তবে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে প্রধানত নির্বাচন হয়ে যাবার পরে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ নীতি নেয়া হলো নির্বাচনের আগে, গুরুত্বটা এখানেই। সেদিক থেকে এটা যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে একটা ইঙ্গিত যে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি তাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা কম। এ উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্র গত দেড় বছর ধরেই বার বার প্রকাশ করে আসছে। এ কারণেই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এটা প্রি-এম্পটিভ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পেছনে কোন কৌশলগত বিবেচনা কাজ করে থাকতে পারে কিনা? কিছু বিশ্লেষক মনে করেন বাংলাদেশকে ঘিরে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গীর যেসব পরিবর্তন হচ্ছে তার মূল লক্ষ্য দেশটিকে চীনের প্রভাববলয়ের বাইরে রাখা। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন,এই নতুন ভিসা নীতির সাথে চীনকে মোকাবিলার কোন সম্পর্ক আছে এমনটা এক কথায় বলা চলে না। যুক্তরাষ্ট্র জানে যে বাংলাদেশে চীন অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতাও অনেক এবং যুক্তরাষ্ট্র সচেতন যে বাংলাদেশ-দক্ষিণ এশিয়ার আরো অনেক দেশের মতই-ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই ভারসাম্য রেখে চলতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটাও দেখতে চায় যেন তারা চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। ওয়াশিংটনে আজকাল স্ট্র্যাটেজির কথা বললেই তা চীনের সাথে জটিলতার লেন্স দিয়ে দেখা হয়। অনেকেই যুক্তি দেবেন যে এ ধরনের নীতি নিলে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, কারণ তা ঢাকাকে চীনের আরো ঘনিষ্ঠ হবার দিকে ঠেলে দিতে পারে, বা এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বেজিং ঢাকার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকুল হবে না। বরং বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটানোর যে কথা আছে-তার আলোকে একে দেখাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়। অন্য আরেকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা যেতে পারে, সম্ভবত বাংলাদেশকে ওয়াশিংটন এটা বোঝাতে চাইছে যে তারা কোন বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায়-এমন ধারণা ঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশে এমন একটা ধারণা অনেকের আছে যে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের বিরোধী, যেহেতু তারা এ সরকারের অনেক সমালোচনা করেছে। কিন্তু এই নতুন ভিসা নীতিতে এটা পরিষ্কার যে এর আওতায় সরকার ও বিরোধীদল উভয়ের লোকেরাই পড়বেন-যদি তারা অবাধ-সুষ্ঠূ নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন। ফলে এটা হয়তো যুক্তরাষ্ট্র যে একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিচ্ছে এ ধারণা জোরদার করার জন্যই নেয়া হয়েছে। নাইজেরিয়া বা উগান্ডার তুলনায় বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুমাত্রিক, এবং বাংলাদেশকে এখন দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ বলে মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে যে বাংলাদেশে একটা অবাধ-সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। এই কথাটাকেই তারা এখন একটা নীতি হিসেবে দাঁড় করিয়ে এক ধরনের সতর্কবাণী হিসেবে তুলে ধরে বলছে যে যদি ভোটের সময় কারচুপি, ভীতিপ্রদর্শন, সহিংসতা বা সভাসমাবেশ ও মতপ্রকাশের অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটে-তাহলে তারা ব্যবস্থা নেবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতাও আছে-যা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট।অন্য আরেকটি কারণ হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আছে এবং এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ তার জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এমন একটা ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিক-যা আসলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কারণ চীনের যে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা তা কেবল অর্থনৈতিক নয় তা একধরনের আদর্শও প্রচার করে। বাইডেন প্রশাসনের ভূ-রাজনৈতিক নীতির একটা দিক হলো চীনের বিরোধিতা করা এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রচার-প্রসার ও তাকে সংহত করা। সেই জায়গাতেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের র্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দফতর গুরুতর মানবাধিকার লংঘন- মূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দফতর। তবে ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু করে। দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা অনেকেই ঢাকায় এসে সরকার ও বিরোধী দলসহ বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা করে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ চাপের মধ্যেই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি বাংলাদেশ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে যেখানে মানবাধিকার ছাড়াও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রসঙ্গ এনে অবাধ বাজার সুবিধা (ইবিএ) বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কী-না সেই প্রশ্নও তুলেছেন। এ সুবিধার অংশ হিসেবে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশের পণ্য। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এর বড় সুবিধাভোগী। এরপর ঢাকায় নির্বাচন কমিশন জানায় যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না বলে তাদের নিশ্চিত করেছে। ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে পর্যবেক্ষক আসবে কি-না তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র জানিয়েছেন অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় আসবে।তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হবে যে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কি-না। কিন্তু অনেকে এ ক্ষেত্রে একটা গুরুতর স্ববিরোধিতাও কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, পৃথিবীতে এমন অনেক দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা দেখা যায় যেখানে গণতন্ত্র বা নির্বাচন বলতে তেমন কিছুই নেই এবং যেসব দেশের মানবাধিকার নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন আছে। ওই দেশগুলোকে ফেলে ওয়াশিংটন হঠাৎ বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে কিনা তা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন? যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মধ্যে আছে, কোথাও গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে সুরক্ষা দেবার চেষ্টা করে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সে অর্থে এটা অনুসৃত হয় না, কারণ ভূ-রাজনীতি ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নের মধ্যে সংঘাত দেখা দিলে তা সবসময়ই ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়। কিছু বিশ্লেষক আছেন যারা মনে করেন যে যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মত যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার পেছনে আসল উদ্দেশ্য এই ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থ- গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন বা মানবাধিকার নয়। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আসলে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব-বলয়ের বাইরে রাখতে চায়। বাংলাদেশ অনেক বছর আগেই চীনের বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়েছিল। গত ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড নামের বেজিং-বিরোধী ক্লাবে যোগ না দেয় এবং এটা করলে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তার এ মন্তব্য ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে একে অপ্রত্যাশিত ও দুর্ভাগ্যজনক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশ অবশ্য কোয়াড অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও যুক্তরাজ্যকে নিয়ে গঠিত কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগে’র অংশ নয়। তবে এ দেশগুলো যে বাংলাদেশকে বাইডেন প্রশাসনের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি-র অংশ করতে চায়-তা মার্চ মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার এক বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য। যাইহোক, সর্বোপরি বিবেচনায় রাখতে হবে, 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারো সাথে শত্রুতা নয়' এ নীতির ভিত্তিতেই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |