ট্রান্সজেন্ডার নারী অধিকারের ভবিষ্যৎ অন্তরায়
মো. খালেদ সাইফুল্লাহ
|
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা আলোচিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও শোরগোল চলছে কিন্তু সাধারণ মানুষের এ বিষয় স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকেই ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া এক করে ফেলছেন অথচ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এমন বাস্তবতায় ট্রান্স বিষয় স্পষ্ট ধারণা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক। মানুষের মধ্যে যাদের দেহ শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি তারা পুরুষ, যাদের দেহ ডিম্বাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি তারা নারী, খুব অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ আছেন যাদের প্রজননব্যবস্থা এবং যৌন বিকাশের ত্রুটি থাকে, তা হলো ইন্টারসেক্স (Intersex) বা আন্তঃলিঙ্গ, তারা হিজড়া হিসেবে পরিচিত। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী জনসংখ্যার মাত্র ০.০১৮% মানুষ ইন্টারসেক্স বা হিজড়া হন। অন্যদিকে নিজেদের ট্রান্সজেন্ডার দাবি করা লোকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্তলিঙ্গ বা ইন্টারসেক্স না। তাদের কোনো ধরনের ডিএসডি (ডিসঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট) নেই। তাদের জন্ম হয়েছে সুস্থ এবং স্বাভাবিক যৌনাঙ্গ নিয়ে। কিন্তু তারা তাদের প্রকৃত লৈঙ্গিক পরিচয় আড়াল করে সামাজিক বা শারীরিক বা আইনি পরিবর্তনের মাধ্যমে বিপরীত লিঙ্গে রূপান্তর হয়। অর্থাৎ ট্রান্সজেন্ডার হলো জন্মগত দেহ যা-ই হোক না কেন, নিজেকে যে নারী দাবি করবে সে নারী , নিজেকে যে পুরুষ দাবি করবে সে পুরুষ , আইনি ও সামাজিকভাবে তাকে মেনে নিতে হবে। মেডিকেল সার্টিফিকেট বা কোন যৌক্তিক প্রমাণ নয় কেবল মনের ইচ্ছা আর দাবি অনুযায়ী এমন অদ্ভুত উদ্ভট সামাজিক, শারীরিক ও আইনি পরিবর্তনগুলােকে ট্রান্স বা রূপান্তর বলা হয়। এটি স্পষ্ট যে হিজড়া একটি জন্মগত জেনেটিক সমস্যা বা ডিসঅর্ডার এবং হিজড়ারা ট্রান্সজেন্ডার নয়। একই সাথে ট্রান্সজেন্ডাররা হিজড়া নয়। কেউ স্ত্রী লিঙ্গের হয়েও নিজেকে পুরুষ হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন। অন্যদিকে কেউ পুং লিঙ্গের হয়েও নারী পরিচয়ে পরিচিত হতে পারেন এমন অবস্থান ট্রান্সজেন্ডারের। নারী তার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্মান ও মর্যাদাকর অবস্থায় উন্নীত হতে পারে এটিই প্রত্যাশা। নারীর অধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে , যখন কোনও বাধা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই নারী নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং নিজেদের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে। নারীর প্রতি সব ধরনের সহিসংতা রোধে ২০১২ সালে দেশে প্রণয়ন করা হয় পারিবারিক সহিংসতা দমন ও নিরাপত্তা আইন ২০১২। নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রণয়ন করা হয় মানবপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, এছাড়া মেয়েশিশুদের নিরাপত্তায় শিশু আইন, হিন্দু নারীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার্থে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতিও গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে নতুন আইন প্রস্তাবিত। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিবেচনায় নিতে হবে। সাম্প্রতিক ট্রান্সজেন্ডার নারীরা আগামী দিনে নারীর অধিকারের অন্তরায় হিসেবে উপস্থিত হবে, ইতিমধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত উদাহরণ দেশ বিদেশে সৃষ্টি হয়েছে। কতিপয় পুরুষ কেবল নিজ ইচ্ছা বা দাবি অনুযায়ী ট্রান্স নারী হয়ে তারা সমাজে নারীদের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি ও সামাজিক শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে পারে। সমাজে নারীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা রয়েছে, কোন পুরুষ ট্রান্স নারী হয়ে এ সুযোগ সুবিধা লুফে নিতে পারে যা নারীর অধিকার হরণ করবে। সাধারণ নারী বনাম ট্রান্স বা রূপান্তরিত দাবিদার নারী একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে ও অসম লড়াই হবে। আমাদের সমাজে নারীরা বিভিন্ন কারণে সামাজিক বৈষম্যের শিকার হন। বৈষম্য নিরসনে নারীদের অগ্রগতি জন্য চাকরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোটা সিস্টেম রয়েছে। যেমন সরকারি প্রাইমারি শিক্ষা কার্যক্রমে শতকরা ৮০ শতাংশ নারীদের জন্য নির্ধারিত। ট্রান্সজেন্ডার নারীরা সেই পজিশনগুলোতে প্রতিযোগিতা করতে আইনি বাধা থাকবেনা। এমতাবস্থায় নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে। পুরুষ হয়েও ট্রান্স নারী দাবি করে প্রকৃত নারীদের আসন বাগিয়ে নিতে পারে। এমন হলে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বের জায়গায় নারীরা পিছিয়ে পড়বে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সংরক্ষিত আসনে ক্ষেত্রেও মনের ইচ্ছার কথা বলে নারীদের আসন কেড়ে নিবে পুরুষ। একজন নার্স বা চিকিৎসক পড়বেন বিড়ম্বনায়। চিকিৎসা সেবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করবে এ পরিচয়ে। কেউ ট্রান্সজেন্ডার ঘোষণা দিলে তার আবাসিক স্থান কোথাও হবে? তারা কোন টয়লেট ব্যবহার? দিন দিন এই সমস্যাগুলো পশ্চিমা দেশেও প্রকট হয়ে উঠছে। ব্রিটেনের মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী- জেলখানায় ১৭৬ জন ট্রান্সজেন্ডার নারীর (জন্মগত পুরুষ) ৭৬ জন যৌন নির্যাতনমূলক অপরাধে জড়িত হয়। এদের ৩৬ জন ধর্ষণ (rape is defined as penetration with penis) এবং ১০ জন ধর্ষণের প্রচেষ্টার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। তাদের জন্য প্রকৃত নারীদের প্রাইভেসি নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাবে। নিউজিল্যান্ডের ট্রান্স মেয়ে Laurel Hubbard ভারউত্তোলনে কলেজ পর্যায়ে পুরুষ হিসেবে রেকর্ড করেছিল স্থানীয় প্রতিযোগিতায় কিন্তু ২০১২-তে সে মেয়ে হিসেবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে কয়েকটি পদক জিতে নেয় মহিলা ইভেন্টে। ক্রিকেটার ম্যাক্সিন ব্লিথিন কেন্ট কাউন্টির টিমে প্রথম ট্রান্স মহিলা হিসেবে অংশ নেয়া তার ব্যাটিং গড় ১২৪ রান। কিন্তু পুরুষ ক্রিকেটার হিসেবে ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ১৫ রান! এভাবে অলিম্পিক, ক্রিকেট, মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার আসরে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে ও তৈরি হচ্ছে যা থেকে সহজেই অনুমেয় ট্রান্সজেন্টার নারী অধিকারের ভবিষ্যৎ অন্তরায়। নারীদের চাকরি বা কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, বাসস্থান, নিরাপত্তা, প্রতিযোগিতাসহ সব সেক্টরে ট্রান্স নারীদের কারণে বৈষম্য তৈরি হবে এবং নারীদের অধিকার খর্ব হবে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কত ভয়ংকর হতে পারে তা অনুমেয়। গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে আমরা যদি শুধুমাত্র আমাদের বিকৃত কল্পনাগুলিকে তৃপ্ত করার জন্য জন্মগত লিঙ্গ পরিচয়কে উপেক্ষা করি তাহলে সামাজিক ভারসাম্য কার্যত ভেঙে পড়বে, নতুন করে নারীর অগ্রযাত্রায় বহুমুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম। ডেল্টা টাইমস্/মো. খালেদ সাইফুল্লাহ/সিআর/এমই
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |