২০২৪ সালে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্বাচন ও পরিবর্তিত ভূরাজনীতি
অলোক আচার্য
|
নতুন একটি বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিশ্ব। চলতি বছর শুরুই হয়েছিল যুদ্ধ এবং তীব্র প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে। বছর শেষেও সেই যুদ্ধই রয়ে গেছে। রাশিয়া—ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযান ইত্যাদি চলছেই। সুতরাং বলা যায় নতুন বছরের শুরুতেই এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, নতুন বছরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচন এবং সম্প্রতি কয়েকটি দেশে নির্বাচন সামনের দিনগুলিতে কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কারণ ভূরাজনীতি এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিনিয়তই ভূরাজনীতির চিত্র পরিবর্তন ঘটছে। ভূরাজনীতিতে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থিররাখা, সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সম্পর্কের মেরুকরণ বাণিজ্য এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করে। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। দেশের সরকার পরিবর্তন হলে পরিবর্তন হয় সেই দেশের নীতি নির্ধারণের বিষয়। কারণ এখন এক দেশের সাথে অপরাপর বহুদেশ জড়িত থাকে বা নির্ভরশীল থাকে। মিত্রতা থাকে এবং এর বিপরীতটাও থাকে। প্রভাব পরে সে কারণেই। যার সাথে সম্পর্ক ভালো তার সাথেই বেশি ঘনিষ্টতা দেখা যায়। উদাহরণস্বরুপ সম্প্রতি মালদ্বীপের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে বর্তমানে চীনপন্থী নেতা মইজ্জু ক্ষমতায় রয়েছেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি ভারতীয় সেনাদের দেশ ছাড়তে বলেন। এভাবে প্রতিটি দেশেরই কোনো না কোনো দেশের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। ক্ষমতার বদল হলেই বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, ক্ষমতার বদল ঘটলে কি ঘটতে পারে? অনেক কিছুই হতে পারে। ক্ষমতার বদল হলে সে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে, পৃথিবীতে যুদ্ধ থামতে পারে আবার আরও জোরেশোরে যুদ্ধ বাঁধতে পারে। এসব সম্ভাবনার কথা, নিশ্চিত নয়। কিন্তু হতে পারে। বিশ্ব একটি নতুন বিশ্ব দেখতে পারে। পরিবর্তন আসবেই তা হোক ইতিবাচক বা নেতিবাচক। পৃথিবী আরও বেশি অসহিঞ্চু হয়ে উঠতে পারে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রে যখন ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন তখন জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে হিসাব নিকাশ এখন থেকেই শুরু করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৪ সালে কট্টরপন্থী সরকার বাড়তে পারে, যা উদারপন্থার জন্য সংকট সৃষ্টি করতে পারে। পৃথিবীর জন্য সত্যিই কোনটি ভালো সেটি নির্ধারণ করবে সেই দেশের জনগণ কিন্তু প্রভাবটা পড়তে পারে বিশ্বজুড়েই বিশেষত যদি পরাশক্তি বা উন্নত দেশের নির্বাচন হয়। এই সংশয় বা সংকোচ বা উদ্বিগ্নতা যাই বলি না কেন সেসব আশঙ্কা হলেও তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জাতীয় ও খ্যাতিমান গণমাধ্যমগুলো থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে ৪০ দেশে ৭০টি নির্বাচন হবে। আফ্রিকা মহাদেশের ১৫টি দেশ, আমেরিকার ৯টি, এশিয়ার ১১টি, ইউরোপের ২২টি ও ওসেনিয়া মহাদেশের চারটি দেশে ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। যদিও সব দেশের নির্বাচন বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু পরাশক্তিগুলোর দেশের নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী বছর বিশ্বের ৪২ শতাংশ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। ৪০টি দেশের দখলে বিশ্বের মোট জিডিপির ৪২ শতাংশ; অর্থাৎ ২০২৪ সালের নির্বাচন অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা পালন করবে। এসব দেশের মধ্যে চারটি নির্বাচন সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখবে বৈশ্বিক ব্যবস্থায়। দেশগুলো হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এসব এলাকায় ২৩০ কোটি মানুষের বসবাস এবং এসব দেশের সম্মিলিত জিডিপি (বার্ষিক দেশজ উৎপাদন) ৪২ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৪২ লাখ কোটি ডলার। ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর আয়োজিত হবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ট্রাম্প এবং বাইডেন দুজনের বয়স কিছুটা বাধা হলেও দুজনই এখনো নির্বাচনের ব্যাপারে একমত এবং শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কয়েকটি জরিপে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলে দেখা গেছে। বিভিন্ন আইনি ঝামেলা পেরিয়ে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিপরীতে বাইডেনের বিরুদ্ধে শেষদিকে অভিশংসন তদন্তের অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ। প্রস্তাবে বলা হয়, বাইডেনের বিরুদ্ধে অভিশংসন তদন্তের অনুমোদন চেয়ে আনা প্রস্তাবের পক্ষে ২২১টি ভোট পড়ে। অন্যদিকে এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ২১২ ভোট পড়ে। মূলত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার ৫৩ বছর বয়সি ছেলে হান্টার বাইডেনের বৈদেশিক ব্যবসা থেকে অন্যায়ভাবে কোনো সুবিধা নিয়েছেন কিনা, তা তদন্ত করে দেখবে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ। তবে ডেমোক্র্যাট এই নেতার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো অন্যায়ের প্রমাণ খুঁজে পাননি রিপাবলিকানরা। কয়েকটি জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে তিনি জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে রয়েছেন। এবারের নির্বাচনে গত বারের মতো হুলুস্থল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না বলেই সবাই মনে করে। ক্যাপিটাল হিলের সেই দাঙ্গার ঘটনা আজও মানুষের মনে আছে। ২০২৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে রাশিয়ার নির্বাচন। ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রপতি পদে আছেন ২৪ বছর ধরে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান নিয়ে প্রথমে রাশিয়া কিছুটা চাপের মুখে পড়লেও ক্রমেই দক্ষ হাতে সেটি তিনি সামাল দেন। অর্থনীতি নিয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়। ৮ ডিসেম্বর তিনি পঞ্চমবারের মতো প্রার্থিতার ঘোষণা দেন। কিছুটা আগাম বলা যায় পুতিনই আবার রাশিয়ার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন। কারণ সেখানে কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো সামনে আসেনি। ১৯৯৯ সাল থেকে রাশিয়ার ক্ষমতায় আছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাতে যেন বাধা না থাকে, তার জন্য ২০২০ সালে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন পুতিন। এবারের নির্বাচনে ইউক্রেনের অধিকৃত কিছু এলাকার মানুষও ভোট দেবে। এবার জিতলে তিনি ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। আমাদের সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারত। বিশ্বে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারত তার সময়ে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছে। অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে ভারত এখন অনেক উন্নত দেশকেই ছাড়িয়ে গেছে। আগামী এক দশকে ভারত চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে বর্তমানে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলিকে। সুতরাং ভারতের নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হত্যায় কানাডার সাথে সম্পর্ক কিছুটা অবনতি হয়। কিছুটা সমালোচিতও হয় ভারত। ২০২৪ সালের এপ্রিল—মে মাসে ভারতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে দেশটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়েছে। গত আগস্টে ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান প্রেরণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। এরপর সূর্যেও তাদের যান রওনা হয়। ২০৪০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ প্রেরণ করারও পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। প্রথমবার মোদী ম্যাজিকে ক্ষমতায় এসে পরেরবারও মোদী ম্যাজিক কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। এবারও মোদী তার ম্যাজিক ধরে রাখবে এমনটাই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সাম্প্রতিক রাজ্যের নির্বাচনগুলো এই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাছাড়া অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দল কংগ্রেস তার পুরোনো অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এএফপির বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের বিপুল পরিমাণ হিন্দু জনগোষ্ঠী মোদির ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করতে পারে। এরপর গুরুত্বপূর্ণ হলো ২০২৪ সালের জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ থেকে ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি ভোটার ৭২০ জন ইউরোপীয় সংসদ সদস্য বাছাই করবেন। স্বাভাবিকভাবেই যেসব দেশে প্রয়োজনীয় সরবরাহ রয়েছে এবং ভূতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে সেখানে বিশ্বের ফোকাসটাও সেখানেই থাকবে। এটাই বিশ্ব রাজনীতি। বিশ্ব রাজনীতি হলো গিভ অ্যান্ড টেক নীতি। এখানে উদারনীতি বলে কিছু নেই। রয়েছে সম্পর্ক উন্নয়নের তোড়জোড়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক এমন একটি জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে প্রতিনিয়তই দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে। পরাশক্তিগুলো নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা করছে। যে দেশের কাছে যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট জড়িত সেখানেই সম্পর্কের তোড়জোড়। স্বার্থ বহুবিধ হতে পারে। তা আঞ্চলিক সুবিধা আদায় হোক,বাণিজ্য স্বার্থ হোক আর তুলনামূলক প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থাকার জন্যই হোক। তাছাড়া রয়েছে ক্ষমতায়নের বিশ্বে ক্ষমতা দখলের তোড়জোড়। এসব নির্বাচন আগামী বিশ্বের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক প্রশ্ন সামনে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন আর কতদিন চলবে অথবা ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ থামবে কবে? এসব ছাড়াও আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন এবং রাশিয়ার সম্পর্ক কেমন হবে সেটাও দেখার বিষয়। লেখক: শিক্ষক, পাবনা ডেল্টা টাইমস/সিআর/এমএনবি |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |