স্বৈরাচারের পতন, তারুণ্যের জয়
মো. রুহুল আমিন
|
আমি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গনঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি আমি দেখেছি চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন। আমি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর কে দেখিনি আমি দেখেছি আবু সাইদ ও মুগ্ধ সহ চব্বিশের শতশত শহীদ ভাইদের। একাত্তর সালের আগে পাকিস্তানের জুলুম দেখিনি, আমি দেখিছি স্বৈরাচারী শাসকের একনায়কতন্ত্র, মানুষের উপর জুলুম অত্যাচার, গুম ও খুন। অবৈধ ভাবে নেতা এবং সরকারি আমলাদের টাকার পাহাড়। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার। কানাডায় বেগম পাড়ায় সরকারি কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রীদের ঘরবাড়ি। বেনজিরের দূর্নীতি, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের ছাগল কান্ড সহ কত কিছু। আমি পাকিস্তানের পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা দেখিনি দেখিছি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করে পালানো। আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছিলো কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে। সরকারি চাকুরিতে বিদ্যামন ৫৬ শতাংশ কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিলো ছাত্ররা। এর সূত্রপাত ঘটেছিলো ২০১৮ সালে তখন তিনি যৌক্তিক সংস্কার না করে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিলো। যেটি ছাত্রদের চাওয়া ছিলো না। ৫ জুন হাইকোর্ট সরকারের জারিকৃত ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে। ৬ জুন ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় থেকে আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে ফেটে উঠে। ছাত্ররা ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেয়। ছাত্রদের দাবি না মানায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সারা দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে আসে। এবারের আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন কোটা বাদ দেওয়ায় অনেক জেলাতে অনেক বেশি ক্যাডার হয়েছে আবার অন্য অনেক জেলায় কোনও ক্যাডারই নেই, নারী ক্যাডারের সংখ্যা কমে গেছে, আদিবাসীদের সংখ্যা কমে গেছে। এই বিষয়ে আমিও একমত যে, এতে সুষম বণ্টন করা যায়নি। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তো এককভাবে প্রধানমন্ত্রীই নিয়েছেন, এটা তো কারো দাবি ছিলনা। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বললেন আমি রাগ করে বাদ দিয়ে দিয়েছি। আপনার মনের কথাটা ব্যক্তিগত অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আপনি বলে ফেলতেই পারেন কিন্তু আপনি সংবাদ সম্মেলন করে বলতে পারেন না। অথচ আপনি শপথ নেওয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিজের আবেগ, রাগে বশীভূত হয়ে এরকম কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ৬ জুলাই থেকে শুরু হয়ে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি। সারদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ অবরোধ করে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে। বাংলা ব্লকেডের দ্বিতীয় দিনে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রেখে সংসদে আইন পাশের একদফা দাবি করেন। হাইকোর্টে রায় চার সপ্তাহ স্থগিত রেখে আপিল বিভাগ রায় দেয়। ছাত্ররা এটিকে সরকারে টেকনিক দাবি করেন। এরপর আন্দোলন থামাতে না পেরে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা এবং আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক ভাবে বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন। গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ এর প্রতিবাদে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরে ‘রাজাকার’ স্লোগান। এর জবাব হিসাবে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিলেন সাধারণ ছাত্রদের শান্তিপূর্ন আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় হয়ে উঠলো রণক্ষেত্র। প্রতিটি হল হয়ে উঠলো রণক্ষেত্র। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে বিভিন্ন জায়গায় থেকে টোকায় ভাড়া করে এনে ছাত্রদের উপর হামলা করলেন। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সরাসরি গুলিতে আবু সাইদকে হত্যা করে আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন। ঢাকার রাজপথে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সূমহ আন্দোলনে নেমে পড়লো। ঢাকায় গুলি চালিয়ে শতশত ছাত্র জনতার বুক ঝাঝরা করে দিলেন। ছাত্ররা যে দাবিতে আন্দোলন করেছিলো মেনে নিলেন এবং তারা যে প্রক্রিয়ায় চেয়েছিল সেভাবেই। তখনি মানলেন যখন আর দাবিদাওয়া আর কোটাতে সীমাবদ্ধ নেই। একদিকে বলা হলো সরকার ও ছাত্রদের চাওয়ায় কোনও অমিল নেই তবে সিদ্ধান্ত আসবে কোর্টে, সরকারই আপিল করবে। ব্যাপারটা এই পর্যন্ত থাকলেই চলত কিন্তু কোটা আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতিবাচক মন্তব্য করে যেতে থাকলেন। আন্দোলনকারীরা সরকারের কোটা সংস্কারের সদিচ্ছাকে সন্দেহ করল, অবিশ্বাস করল এবং আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকলো। আন্দোলন শাহবাগ পেরিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল। সরকার যথারীতি ছাত্রদের ক্ষমতাকে পাত্তা দিলো না। প্রথমে আন্দোলন সাধারণ ছাত্ররাই করেছে এবং তার যৌক্তিকতাও ছিল। যখন এমন একটা আন্দোলনের প্রতিপক্ষ আওয়ামীলীগ সরকার তখন বিএনপি জামাত এর লোকজন যে এতে অংশগ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। তারা দিনের পর দিন আল্টিমেটাম দিয়েও একটা সফল আন্দোলন করতে পারেনি, কারণ তাদের কাছে জনগণের সমর্থন নেই। বিক্ষুব্ধরা আওয়ামীলীগকে দেখতে পারেনা এর মানে এই না যে তারা জামাত বিএনপিকে পছন্দ করে। তাই অন্যের আন্দোলনে শরিক হওয়া ছাড়া তাদের বিশেষ রাস্তাও নেই। ভুলটা এখানেই করলেন। একটা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে আপনারা জামাত বিএনপির ষড়যন্ত্র বললেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন। আন্দোলনকারীরা তাই ক্ষোভে ফেটে পড়ল। আন্দোলনকারীদের আত্মসম্মান বোধে আঘাত হানলেন। এই প্রজন্মের আত্মসম্মানবোধ খুবই শক্ত। বিএনপি জামাতকে ১৫ বছর ধরে যে কায়দায় প্রতিহত করেছেন। সেই কায়দায় ছাত্রদের প্রতিহত করতে চাইলেন। আন্দোলনকারী সমন্বয়কারীদের গুম আটক করে নির্যাতন করলেন। আন্দোলনে হতাহত ছাত্রদের খোঁজ খবর না নিয়ে সরকার দালান কোটার শোকে মায়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মানুষের জীবনের চেয়ে আপনাদের দালান কোটা বড় হয়ে গেলো। সারা দেশে গন গ্রেপ্তার এবং ছয় সমন্বয়ক কে ডিবি কার্যালয়ে নিরাপত্তার অযুহাতে আটকিয়ে রাখলেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের লিখিত ভিডিও বার্তা ছড়িয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু ছাত্ররা সে ফাঁদে পা দেয়নি। সরকার লোক দেখানো শোক পালন করার ঘোষণা দিলো কিন্তু ছাত্ররা সেই শোক কে প্রত্যাখান করে সবাই লাল কাপড় মুখে চোখে বেধে এবং ফেসবুক প্রোফাইল পরিবর্তন করে প্রচার করতে লাগলো। জনগণকে অন্য দিকে ব্যাস্ত রাখতে জামাত শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেন। ছয় সমন্বয়ক ৩২ ঘন্টা অনশন করার পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছেড়ে দিলেন। তারা ৯ দফা দাবি নিয়ে কর্মসূচি করতে থাকলে তাতেও গুলি চালিয়ে নির্বাচারে মানুষ মারলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে অসহযোগ আন্দোলন এবং এর রূপরেখা ঘোষণা করেন। অসহযোগ আনদোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি সকল পেশাজীবি মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ গুলা প্রকাশ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্ন ভাবে অপব্যবহার করে ফায়দা লুটিয়েছেন। মানুষের কাছে দুইটি জিনিসের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেললেম। মানুষ তার ভোট দেওয়ার গনতান্ত্রিক হারিয়েছে। আওয়ামীলীগ দেশটাকে একনায়কতন্ত্র বানিয়েছে। আওয়ামীলীগের টিকিট পেলেই যেন জয় চুড়ান্ত। জনপ্রতিনিধিরা এখন জনগনের কথা ভাবেন না। তারা টাকার কথা ভাবেন। কিভাবে দলের উপর মহলকে টাকা খাইয়ে নৌকার টিকিট পাওয়া যাবে সেটির কথা চিন্তা করেন। দলীয় টিকিট পেলে দলীয় ক্যাডার এবং প্রশাসনের দ্বারা বিজয় নিশ্চিত। এ কারণে তারা জনগনের কাছে থেকে দূরে সরে গিয়েছে। মানুষ বাকস্বাধীনতা হারিয়েছে। মানুষ দ্রব্য মূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন যাপন করতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লেও তাদের জীবনযাত্রার মান কমিয়েছে। কারণ দূর্নীতি করে কেউ সম্পদের পাহাড় গড়েছে বিপরীতে অনেকের মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়েছে দূর্নীতি বাজদের জন্য। বিপরীত পক্ষকে দমন পীড়ন নীতি। নেতাদের সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে সম্পদের পাহাড়। এসবে কারণে মানুষ কথা বলার সাহস পায়নি। তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছাত্রদের সাথে রাজপথে নেমে পড়ে। ছাত্রদের সাথে গণমানুষের অংশগ্রহণে টিকতে না পেরে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। ছাত্র সমাজকে সুন্দর আগামী গড়ার জন্য কাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে কোন দল যেন একনায়কতন্ত্র বানিয়ে দেশকে ধ্বংস না করে সেদিকে সকল নাগরিককে খেয়াল রাখতে হবে। জ্বালাও পোড়াও এর রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। দেশের মানুষ যেন বাকস্বাধীনতা না হারায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে। মেধার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিনির্মান করতে হবে। দেশের গবেষণা ক্ষাতকে সমৃদ্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাজনীতি দূর করতে হবে। সকল নাগরিককে দূর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মেধার ভিত্তিতে সিট বন্টন করতে হবে। কোন রাজনৈতিক দল যেন হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ না পায় সেদিকে প্রশাসনের খেয়াল রাখতে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত দেশ গঠন করতে হবে। দেশের সব কিছু ঢেলে সাজিয়ে সোনার বাংলায় রূপ সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। ডেল্টা টাইমস/মো. রুহুল আমিন/সিআর/এমই
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |