কুরস্ক অভিযানে সাফল্যে ইউক্রেনের লাভ
অলোক আচার্য:
|
রাশিয়ার ভিতরে ঢুকে ইউক্রেনের সামরিক অভিযান গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্বের মনোযোগ কেড়েছে। আক্রমণের শুরুর পর থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের এলাকা দখল করতে থাকলেও ইউক্রেন এতকাল শুধু ডিফেন্স মানে প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণ ঠেকাতেই ব্যস্ত ছিল। রাশিয়াকে প্রতিব্যস্ত করার মত কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। খুব সম্প্রতি এসে ইউক্রেন তার নিকটবর্তী রাশিয়ার করস্কের একেবারে ভিতরে ঢুকে যায় এবং রাশিয়ান বাহিনীকে পিছনে ঠেলে দেয়। আপাত দৃষ্টিতে এটি ইউক্রেনের একটি বিজয়। তবে সামগ্রিকভাবে এতে ইউক্রেনের লাভ না ক্ষতি হচ্ছে সেটি দেখতে হবে। কিয়েভে এক সম্মেলনে সিরস্কি স্বীকার করেছেন, কুরস্ক অঞ্চলে অভিযান চালানোর একটি লক্ষ্য হলো ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল থেকে রাশিয়ার সেনাদলগুলোকে সরানো। অর্থাৎ রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্বঞ্চলে ক্রমাগত ভিতরে প্রবেশ করছে যা ইউক্রেনের এই অঞ্চলের জন্য হুমকি। ফলে রাশিয়ার শক্তি এদিকে ঘোরাতে এবং ঐ অঞ্চলে হামলা কমাতে বাধ্য করে রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা। বিপরীতে রাশিয়ার অনেক সেনাসদস্যকে আটক করারও কথা জানিয়েছে ইউক্রেন। রাশিয়ার গত দুই বছরেও এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়নি। নিজের মাটিতে ইউক্রেন যে এভাবে দখল নিতে পারে সেটি বুঝতে পারেনি। কিন্তু ইউক্রেনের এখানে খুব বেশি লাভ হবে বলে মনে হয় না। রাশিয়া পূর্ণ শক্তি নিয়ে আবারও আক্রমণ চালাবে যা ইউক্রেনকে বিপদে ফেলতে পারে। ইতিমধ্যেই ইউক্রেন জানিয়েছে রাশিয়া তাদের ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে এবং ইউক্রেন তার সেনাপ্রধানে পরিবর্তন এনেছে কিন্তু কুরস্ক সাফল্য ধরে রাখতে পারবে কি না সেটাই প্রশ্নের। আর ধরে রাখলেও ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদী লাভ হবে কতটুকু সে হিসাবও করতে হবে। কারণ রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের একটি শান্তি আলোচনার বিষয়ে যখনই উদ্যোগ চলছিল তখন এই পরিস্থিতি রাশিয়াকে শান্তি আলোচনাকে আরও দূরে ঠেলে দিতে পারে। যদিও রাশিয়ার এ থেকে একটি বিষয়ে ধারণা হয়েছে যে ইউক্রেন ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেনের সামরিক অভিযানের পর থেকেই প্রশ্ন সামনে আসে যে এই যুদ্ধ কতদিন চলবে? কারণ ইউক্রেনের প্রতিরোধ পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্যে চলতে থাকে। এখনো সেটাই চলছে। কিন্তু কতদিন? কারণ এরই মধ্যে নতুন সংকট হিসেবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের সামরিক অভিযান চলছে। বিশ্বের মনোযোগ এখন সেদিকে। বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনেও সংকট চলছে এবং সেই সংকট কোনো অংশে কম নয়। জেলেনস্কি ইতিমধ্যেই সেই অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সবার মনোযোগ সরিয়ে নেওয়াটা ছিল রাশিয়ার লক্ষ্য। তাছাড়া পশ্চিমা বিশ্বও এখন ইউক্রেনে সাহায্যের বিষয়ে নতুন চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করেছে। এতদিন ইউক্রেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য পায়নি। বিপুল সংখ্যক সৈন্য হারিয়েছে এবং সেই সাথে সম্পদও। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো এখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তিচুক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। যদিও এখন আমেরিকা ব্যস্ত আছে নির্বাচনে। একটি বিষয় যে রাশিয়ার ধীরে চলো নীতি যুদ্ধে রাশিয়াকে সাফল্য এনে দিয়েছে। যুদ্ধে সমরাস্ত্র এবং মনোবল এই দুটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে ইউক্রেন পুরোপুরিভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। একেবারেই নির্ভরশীল হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন। কারণ যেকোনো সময় পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। হঠাৎ হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এবং অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় বিশ্বের মনোযোগ সেদিকে ঘুরে গেছে। ঠিক এই জায়গাতেই রাশিয়া লাভবান হবে বা হচ্ছে। কারণ এতদিন যুদ্ধ বলতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানই ছিল একমাত্র যুদ্ধ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সর্বোতভাবে ইউক্রেনের পাশে ছিল। ইউক্রেন নিয়ে কারো তেমন কোনো মাথাব্যথা দেখাও যাচ্ছে না। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে এক তরফা প্রায়ই রাশিয়া সাফল্য পাচ্ছিল। হঠাৎ ইউক্রেনে ঘুরে দাঁড়িয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করা এবং দখলে রাখার বিষয়টি রাশিয়াও ভাবতে পারেনি। সুতরাং যুদ্ধ একটি স্থির পর্যায়ে পৌছেছে। এখানে রাশিয়া নতুন করে যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ইউক্রেন বর্তমান অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি তাদের পূর্বাঞ্চলের রাশিয়াকে রুখতে হবে। এটা যদিও কঠিন। সেকারণেই প্রশ্ন হলো কুরস্কে ইউক্রেন কতদিন অবস্থান করবে? এটা যদি দীর্ঘ সময় হয় তাহলে এখানেও ভয়াবহ যুদ্ধ হবে। ফলে কার্যকর কথা হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বন্ধ আলোচনায় সমাধান খোঁজাই হবে ইতিবাচক পরিণতি। যুদ্ধের মূল হলো অস্ত্র যা বরাবরই ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে পেয়েছে এবং এখনো পাচ্ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ড কমলা হ্যারিস এবং ট্রাম্প যে-ই আসুক সেটাও একটা প্রভাব ফেলতে পারে এই যুদ্ধে। এভাবে আরও সামরিক সহায়তা ইউক্রেন পাবে অন্তত যতক্ষণ যুদ্ধের বন্ধের ব্যাপারে কোনো সমাধানে না পৌছাতে পারে। সেক্ষেত্রে ইউক্রেন পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো মোটামুটি যুতসই অস্ত্র পাচ্ছে এবং এর ফলশ্রুতিতে এই যুদ্ধ আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে এটা বলাই যায়। এই যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনের মাটিতেই, যুদ্ধ করছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী কিন্তু অস্ত্র,অর্থ এবং অন্যান্য জিনিসের যোগান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রক্সিযুদ্ধ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিশ্লেষণে এমনটাই উঠে এসেছে। সুতরাং অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র একটি যুদ্ধ ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ উভয়পক্ষের সম্মতিতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে রাজী করানো যায় এবং তা আলোচনার মাধ্যমে। যুদ্ধের একেবারে শুরুতে যুদ্ধ শুরুর একটি কারণ ছিল ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি নিয়ে যা রাশিয়ার আপত্তির এবং উদ্বেগের বিষয় ছিল। ন্যাটোর সম্প্রসারণ রাশিয়ার উদ্বেগের কারণ। রাশিয়ার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রথম থেকে কৌশলগতভাবে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমেই পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান শুরু করেনি। প্রথমে যুদ্ধ সম্পর্কে যা অনুমান করা হয়েছিল তা ঠিক হয়নি। সহজেই ইউক্রেনকে দমাতে পারেনি। এর কারণ ইউক্রেনের যুদ্ধ কৌশল এবং পশ্চিমা বিশ^ এবং মিত্র দেশগুলোর অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা। রাশিয়ার এ অভিযানে উদ্দেশ্য কি কিয়েভ দখল করা না ইউক্রেনকে ন্যাটো যোগদান থেকে বিরত রাখা এসব প্রশ্নই থেকে গেছে। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার যুদ্ধ কৌশল সফল হয়েছে। কিন্তু এই পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে কতদিন যুদ্ধ চলবে? কারণ অস্ত্র ভান্ডারেও তো টান পরে। আবার রাশিয়ার অবস্থাও একই। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচুর অস্ত্রের দরকার হচ্ছে? কারণ যুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রয়োজন প্রচুর প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র। সেই অস্ত্র তৈরি করতেও তো সময়ের দরকার। এখনও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে কিন্তু নিজের দেশের অস্ত্রভান্ডারও তো সুরক্ষিত রাখতে হবে। কারণ নিজ দেশের নিরাপত্তাই সর্বাগ্রে। ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্ত্রের পাশাপাশি চলছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও। দুটি দেশ যুদ্ধে জড়ালেও বাস্তবিকপক্ষে এর সাথে পরোক্ষভাবে অন্য দেশও জড়িত। পরস্পর নির্ভরশীল বিশে^ কেউ কাউকে পুরোপুরিভাবে এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব। এতে যেমন ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে তেমনি উন্নয়নশীল বিশ^ এর ফল ভোগ করে। এক দেশের কোনো সম্পদের ওপর অন্য এক বা একাধিক দেশ নির্ভর করে। উপরন্তু সেই দুটি পক্ষ যদি হয় পরাশক্তি। সেই বহু বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগীতা চলে আসছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশে^র রাজনীতি পাল্টে দিয়েছে। মাঝে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব এলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। এর আগে আলোচনার প্রস্তাবে রাশিয়ার গণভোটকৃত অঞ্চলগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার শর্ত রাখে। বিপরীতে তারা অস্ত্র সহায়তা পাচ্ছে যা দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। কিন্তু কতদিন? যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো কতদিন সহায়তা অব্যাহত রাখতে পারবে এবং রাশিয়াও কতদিন সময় নিবে ইউক্রেন দখল করতে। ইসরাইল-হামাসের যুদধ বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকায় ইউক্রেন বিষয়টি এখন কম আলোচিত। এই যুদ্ধের শেষটা কিভাবে হবে সেটি জানা না গেলেও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যেভাবেই হোক যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়াটাই বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্তি¡র কারণ। কিন্তু ইউক্রেনের কুরস্ক অভিযানে চলমান সাফল্য এবং রাশিয়ার মনোভাব এই যুদ্ধ সম্ভবত আরও বেশি দীর্ঘায়িত এবং ক্ষয়ক্ষতিপূর্ণ করতে পারে। লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট, পাবনা। ডেল্টা টাইমস/অলোক আচার্য/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |