দুঃসহ ৪৯ দিনের স্মৃতি ভুলতে চান আমিরাতফেরত বাংলাদেশিরা
প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরলেও তছনছ হয়ে গেছে জীবন
ডেল্টা টাইমস ডেস্ক:
|
চোখের পলকে এলোমেলো হয়ে গেল সব। দেশে গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে দাঁড়ালাম ব্যানার নিয়ে। আবুধাবির পুলিশ ধরে নিয়ে কাউকে দিয়ে দিল যাবজ্জীবন, কাউকে জেল। কারাগারে শুধু কাঁদতাম, নামাজ পড়তাম, আর রোজা রাখতাম। এক বেলা ভাত দিত। দুই বেলা রুটি। এক রুমে থাকতাম ৩০ জন। এভাবেই কাটে ৪৯ দিনের অনিশ্চিত জীবন। মুক্তির খবর যেদিন শুনলাম, মনে হলো নতুন জীবন পেয়েছি। তবে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরলেও সব তছনছ হয়ে গেছে। কিছুই আনতে পারিনি। কখনও আর যেতেও পারব না। বাকি জীবন কীভাবে কাটাব? মাথায় ঋণের বোঝা। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের রাউজানের মধ্যম কদলপুর এলাকার মোহাম্মদ কাউছার উদ্দিন। কথা বলার সময় তাঁর চোখ অশ্রুতে টলমল করছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশির একজন তিনি। তারা মোট ১২ জন গত শনিবার রাতে আরব আমিরাত থেকে দেশে ফিরেছেন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট মোহাম্মদ কাউছার উদ্দিন। বাবা শামসুল হুদা ছোটখাটো চাকরি করেন। বড় দুই ভাই বেকার। মা রশিদা বেগম গৃহিণী। ছেলেকে বরণ করতে শনিবার রাতে বিমানবন্দরে ছুটে আসেন রশিদা। সঙ্গে আসে কাউছারের ছোট্ট মেয়েও। ছেলেকে পেয়ে রশিদা অঝোরে কাঁদতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘যখন শুনেছি, ছেলে আমার জেলে; তখন থেকে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার উদ্যোগ না নিলে হয়তো ছেলের দেখা পেতাম না। এ জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’ তিনি বলেন, ‘ছেলেকে তো ওরা একবারে পাঠিয়ে দিল। এখন কী করে খাবে? এই ছেলের টাকায় সংসার চলত আমাদের।’ কথা শেষ হতে না হতেই কান্নার রোল শোনা গেল চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখানে কাউছারের সঙ্গে এসেছেন আরও ১১ বাংলাদেশি। স্বজনকে পেয়ে তারা কান্না জুড়ে দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আরব আমিরাতে যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া মেহেদী হাসান রিপন ও জহিরুল ইসলাম নাহিদও। ছিলেন মেহেরাজ উদ্দিন রাসেল, মোহাম্মদ হারুন, শাহজাহান, মোহাম্মদ সবুজ ও সাইদুল হক। তাদের অধিকাংশের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারীতে। মেহিদী হাছান রিপন বলেন, ‘আমিরাতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ২৫ বছরের জেল। মওকুফ না হলে বাকি জীবন হয়তো জেলেই কাটাতে হতো। কিছুই আনতে পারিনি। শুধু প্রাণটা নিয়ে এসেছি।’ মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘আরব আমিরাতে পরিচিতজনদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। সেখানেই কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে প্রতিবাদ জানাতে একত্রিত হই সবাই। কিন্তু পুলিশ যে এত বড় প্রতিক্রিয়া দেখাবে, জানা ছিল না।’ অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দণ্ড মওকুফের উদ্যোগ নেওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানান সাইদুল হক। তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম, দণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে আর মুক্তি মিলবে না। কিন্তু সরকার উদ্যোগ নেওয়ায় মুক্ত হয়েছি। চাকরি গেলেও অন্তত পরিবারের সঙ্গে একত্রিত হতে পারছি। আমাদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া আরও অনেকে এখনও সেখানে বন্দি আছেন। সরকার যেন তাদেরও মুক্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়।’ চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে রাতেই নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন আবুধাবিফেরত বাংলাদেশিরা। অসুস্থ হওয়ায় ছেলেকে আনতে বিমানবন্দরে যেতে পারেননি শামসুল হুদা। তিনি বলেন, ‘চার বছর আগে আবুধাবিতে পাঠাই ছোট ছেলেকে। অনেক টাকা ঋণ করে পাঠিয়েছি। কিন্তু ছোট্ট একটি ঘটনায় সব এলোমেলো হয়ে গেল। আর কখনও আমার ছেলে ওই দেশে যেতে পারবে না। আমরা কীভাবে খেয়ে বাঁচব?’ ডেল্টা টাইমস/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |