ট্রাম্প-হ্যারিস ভোটযুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রত্যশা
খন্দকার আপন হোসাইন:
|
ট্রাম্প-হ্যারিস ভোটযুদ্ধের পূর্বনির্ধারিত দিন ৫ই নভেম্বর। স্মরণকালের সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডেমোক্রেটিক মনোনীত কমলা হ্যারিস কিংবা রিপাবলিকান মনোনীত ডোনাল্ড ট্রাম্প এই দুইজন হেভিওয়েট প্রার্থীর মধ্য থেকে যে কোন একজন হতে যাচ্ছে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তথা বিশ্বমোড়ল। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভবিষ্যৎ। এবারের মার্কিন নির্বাচন নানাবিধ কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এবারই প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন নারী প্রার্থীর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ভোটযুদ্ধে জয় পেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হবে কমলা হ্যারিস। ভোটযুদ্ধের ফলাফলের অপেক্ষায় সমগ্র বিশ্ব। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব ভোট রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ইলেকটোরাল কলেজ-ব্যবস্থার অধীনে। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকটর থাকে। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৪৮টির জন্য নিয়ম হলো যে প্রার্থী সাধারণ নাগরিকদের ভোটে জিতবে ওই প্রার্থীই সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্যের সকল ইলেকটোরাল ভোট পাবে। সেখানে পপুলার ভোটের ব্যবধান কম হলেও একই নিয়ম বিদ্যমান। নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে জয়ী হওয়ার জন্য ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি ভোট পেতে হয়। আর এ ক্ষেত্রে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলো বড় ভূমিকা পালন করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আগাম ভোট এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি ভোটার আগাম ভোট দিয়েছে। জানা গেছে ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার ইলেকশন ল্যাব প্রায় ছয় কোটি আঠারো লক্ষ একুশ হাজার ব্যালট গণনা করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম এই ভোট নিয়ে নিয়মিত জরিপ প্রকাশ করছে। আগামী ৫ই নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। কে হতে যাচ্ছে হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা? ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি কমলা হ্যারিস? চলছে জল্পনা কল্পনা। এত দিন পর্যন্ত অধিকাংশ জনমত সমীক্ষায় রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্প তাঁর ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী কমলার চেয়ে পিছিয়েই ছিলো। কিন্তু ভোটের দেড় সপ্তাহ আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত জনমত সমীক্ষায় এগিয়ে গেছে ট্রাম্প। গত ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ এর জাতীয় জরিপেও কমলা হ্যারিসের জনসমর্থন ট্রাম্পের চেয়ে দুই শতাংশ বেশি ছিল। ২১ অক্টোবরে এসে সেই ব্যবধান ১ শতাংশে নেমে আসে। আর সর্বশেষ ২৮ অক্টোবরের তথ্যানুসারে, কমলা হ্যারিসের জনসমর্থন ৪৯ শতাংশ যা কিনা ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে মাত্র ০.৯৯ শতাংশ বেশি। ফোর্বসের প্রতিবেদনে কয়েকটি জরিপের ফল উঠে এসেছে। এগুলোর কয়েকটিতে কমলা ও কয়েকটিতে ট্রাম্প এগিয়ে। ২৭ অক্টোবর প্রকাশিত এবিসি ও ইসসোসের জরিপে ৫১ শতাংশ পয়েন্ট নিয়ে ট্রাম্পের ৪৭ শতাংশের চেয়েও এগিয়ে ছিল কমলা। একই দিন সিবিসি জরিপের ফল প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, কমলা ও ট্রাম্পের ব্যবধান মাত্র ১ পয়েন্ট- যথাক্রমে ৫০ ও ৪৯ শতাংশ। সিএনএন ও এসএসআরএসের জরিপে কমলার চেয়ে ১ পয়েন্টে এগিয়ে ছিল ট্রাম্প। এ জরিপে ৪৮ শতাংশ ভোটার ট্রাম্পকে ও ৪৭ শতাংশ কমলাকে সমর্থন করেন। সিএনবিসির সাম্প্রতিক জরিপেও ২ পয়েন্টে এগিয়ে আছে ট্রাম্প। এ অবস্থায় দুই প্রার্থীর জনপ্রিয়তা অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। কমলা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ই যার যার দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনের ইচ্ছা পোষণ করেছিল। দলের বড় বড় নেতাদের কেউ তাকে দলীয় প্রাথমিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আহ্বান জানায়নি। পুনঃনির্বাচনের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিল একমাত্র জো বাইডেন। মার্কিন নির্বাচনের প্রায় একবছর আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিল জো বাইডেন। মনের জোর থাকলেও বয়সের ভারে একরকম নুহ্য হয়ে পড়েছে জো বাইডেন। বয়সের চাপে নির্বাচনী প্রচারে সফল না হওয়ায় দিনদিন জনসমর্থন কমে যাচ্ছিল। ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি বিতর্কে খুব এলোমেলো কথা বলে ফেলেছিলো জো বাইডেন। ফলে নির্বাচন নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের হতাশা দিন দিন বাড়তে লাগলো। অবশেষে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হতাশার অতল গহ্বর থেকে উত্তোলিত করতে আলোর মশাল প্রজ্জ্বলন করলো জো বাইডেন নিজেই। আসন্ন নির্বাচনের প্রায় চার মাস আগেই ২১ জুলাই জো বাইডেন তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দিয়ে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। রাতারাতি ডেমোক্র্যাটদের মনে হতাশার অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আশার আলো জ্বলতে লাগলো। কমলা হ্যারিসের মার্জিত ব্যক্তিত্ব আর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর নির্বাচনি প্রচারণায় প্রাণ ফিরিয়ে আনলো। অপরদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প গত চার বছর ধরেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। তিনি ২০২০ এর মার্কিন নির্বাচনে পরাজিত হলেও জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেয় নাই। ট্রাম্পের অভিযোগ তাকে চালাকি করে হারানো হয়েছিলো। রিপাবলিকান পার্টির মূল নেতাদের সবাই ট্রাম্পকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন করেছে। ফলে ট্রাম্পই হয়ে উঠেছে রিপাবলিকান পার্টির একচ্ছত্র অধিপতি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। জো বাইডেনের বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেরকম জ্যোতি ছড়িয়েছে কমলা হ্যারিস আসার পর ট্রাম্পের সে জ্যোতি যথেষ্ট কমে গেছে। বিশ্বজুড়ে শুধু যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদ। দাবানলের মতো চতুর্দিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে বহু দেশ। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-হামাস, ইসরায়েল-ইরান, ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ চলমান। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে কেবল আতঙ্ক আর আতঙ্ক। ঠিক এই সময়ে মার্কিন নির্বাচন শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২০ এর নির্বাচনের পরের বছর থেকেই সাধারণ মার্কিন নাগরিক মূল্যবৃদ্ধি বা উদ্বাস্তু-সমস্যার দায় চাপিয়েছে জো বাইডেন ও তার দলের উপর। অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা-ভারাক্রান্ত সাধারণ মার্কিন নাগরিক বৈশ্বিক খবরদারির চেয়ে নিজের দেশের উন্নতি চেয়েছে বেশি। সাধারণ মানুষের এই মনোভাব অনুধাবন করতে পেরেছিলো ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারসভায় ট্রাম্প বলে বেড়িয়েছে যে 'এই সরকার আমাদের করের টাকা ইউক্রেন ও ইসরায়েলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই সরকার বহিরাগত শরণার্থীদের জন্য হোটেল ভাড়া করছে আর আমাদের ঠিকানা রাজপথ।’ ট্রাম্পের এই কথাগুলো অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সাধারণ মানুষদের অনেকেই বলতে শুরু করেছিলো ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে সবার উন্নতি হবে। পক্ষান্তরে দেশটির নারীশক্তি জোট বেঁধে প্রচার প্রচারণা চালিয়েছে কমলা হ্যারিসের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মুসলিম বাইডেন-হ্যারিসের ইসরায়েল নীতিতে বিরক্ত। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের সমর্থন ট্রাম্পের দিকে। ট্রাম্পের উপর গোলাবর্ষণের পর থেকে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকরাও ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছে। তবে অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গের ধারণা, ট্রাম্প নয় বরং হ্যারিসই তাঁদের জন্য উপকারী হবে। তরুণ ভোটারদের একাংশ কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করলেও ডেমোক্র্যাটদের ইসরায়েল নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা গ্রিন পার্টিকে সমর্থন করতে চাইছে। সামান্য ভোটের ব্যবধানে কেউ জয়ী হবে কেউ হবে পারাজিত। জানা যায় কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টায় একরকম মরিয়া কমলা হ্যারিস। কিন্তু ন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর দ্য এডভান্সমেন্ট অব কালারড পিপল সেপ্টেম্বরের জরিপমতে অনূর্ধ্ব ৫০ বছর বয়স্ক প্রতি চারজন পুরুষ ভোটারের মধ্যে একজন ভোটার ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক। আর এ জন্যই কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ভোটারদের তিরস্কার করেছে সাবেক কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মার্কিন নির্বাচনে অন্যতম প্রধান আলোচিত ইস্যু মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত। গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরে সংঘটিত ইসরায়েলি গণহত্যার ক্ষেত্রে উভয় দলের অবস্থানই এক ও অভিন্ন। ইসরায়েলি বর্বরতায় উভয় দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরই মৌন সমর্থন রয়েছে। বস্তুত গাজায় সংঘটিত ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসন ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুজন প্রার্থীই গাজায় বোমাবর্ষণ, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা, চিকিৎসার সুযোগ না দেয়া, রোগের বিস্তার ঘটানো, জোরপূর্বক স্থানান্তর ইত্যাদি ভয়ংকর নীতির প্রশ্নে নিশ্চুপ। সুতরাং ৫ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনের সম্ভাবনা শূন্য। ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস অবশ্য নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধ করার কথা বলেছে। সেই সাথে এ কথাও বলেছে ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও অদ্যাবধি একই কথার উপরই রয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্প গাজায় মানুষ হত্যা বন্ধ করার সময় এসেছে বলে বক্তব্য দিলেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করতে একটি বাণীও উচ্চারণ করেনি। সুতরাং পরিষ্কারভাবেই বলা যায় মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল আর যাই হোক মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা আনয়নে কোন ভূমিকা রাখবে না। লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও সংগঠক। ডেল্টা টাইমস্/খন্দকার আপন হোসাইন/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |