চীন-আফ্রিকার ডিজিটাল অর্থনীতি ও সবুজ উন্নয়ন
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের ২০২৪ সালের শীর্ষ সম্মেলন এফওসিএসি’র জন্য চীন সফররত আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) কমিশনের চেয়ারপারসন মুসা ফাকি মাহামতের সঙ্গে আলোচনার সময় এ কথা বলেন শি।আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মূল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এইউ-এর তাৎপর্য তুলে ধরেন শি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও এইউ’র মধ্যে গভীর রাজনৈতিক আস্থার কথাও উল্লেখ করেন শি চিন পিং। আলোচনায় চীনের অর্থায়নে আফ্রিকা সেন্টারের কাজের পরিসমাপ্তি এবং এর সফল কার্যক্রমকে ইঙ্গিত করে আফ্রিকার স্বাস্থ্য খাত এবং এর জনগণের মঙ্গলজনক অবদানের ওপর জোর দিয়েছেন চীনা প্রেসিডেন্ট। আফ্রিকান ইউনিয়নে চীনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে শি জিনপিং আরও বলেন, এফওসিএসি শীর্ষ সম্মেলনটিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছে চীন। চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের শীর্ষ সম্মেলনে যৌথভাবে আধুনিকীকরণকে উন্নীত করতে চীন ও আফ্রিকা সহযোগিতার নতুন পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। ৬ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ে অষ্টম চীন-আফ্রিকা উদ্যোক্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এটি শীর্ষ সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক কার্যকলাপ। চীনা ব্যবসায়িক প্রতিনিধি ছাড়াও, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কেনিয়াসহ ৪৮টি আফ্রিকান দেশের ব্যবসায়িক প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করেছেন। চীন-আফ্রিকা সহযোগিতার ফোরামের এই শীর্ষ সম্মেলনে, চীন প্রস্তাব করেছে যে আগামী তিন বছরের মধ্যে যৌথভাবে আধুনিকীকরণকে উন্নীত করার জন্য আফ্রিকার সাথে দশটি অংশীদারিত্ব মূলক কর্ম সম্পাদন করতে ইচ্ছুক বেইজিং। শিল্প ও সরবরাহ চেইনের আরও একীকরণ থেকে সুযোগ আসে এবং তা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতার ভিত্তি। আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়ায় চীন‘মেড ইন আফ্রিকা’পণ্যের গুণমান উন্নত করতে এবং আপগ্রেড করতে সহায়তা করতে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ও শিল্প চেইন সরবরাহ করতে পারে। একই সময়ে, আফ্রিকান পণ্যগুলো চীনের পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রবেশ করতে পারে এবং আরও উন্নয়নের সুযোগ পেতে পারে। নতুন গতির ক্রমাগত সঞ্চয় থেকেও সুযোগ আসে।'সিল্ক রোড ই-কমার্স’ সম্প্রসারণের জন্য একসাথে কাজ করা থেকে শুরু করে চীনের ব্যাটারি গাড়ি, সৌরপ্যানেল এবং বায়ুশক্তি সরঞ্জাম আফ্রিকায় নতুন শক্তির বিকাশে সহায়তা করছে। চীন ও আফ্রিকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সবুজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে গভীর সহযোগিতা করেছে।সুযোগগুলো অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ সহযোগিতার ধারণা থেকে আসে। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, চীন প্রস্তাব করেছে যে, বেইজিং একতরফাভাবে বাজার উন্মুক্তকরণের উদ্যোগ নিতে ইচ্ছুক, এবং ৩৩টি আফ্রিকান দেশসহ চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন সমস্ত স্বল্পোন্নত দেশকে ১০০% শূন্য-শুল্ক সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের সাথে সাধারণ উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক অংশীদারি সম্পর্ক কাঠামোগত চুক্তি নিয়ে আলোচনা ও স্বাক্ষর করার প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে ইচ্ছুক চীন। এটি চীনের বড় বাজারকে আফ্রিকার জন্য একটি বড় সুযোগে পরিণত করবে এবং একটি উন্মুক্ত বিশ্ব অর্থনীতির নির্মাণকে উৎসাহিত করবে। বিগত দশ বছরে, চীন-আফ্রিকা পারস্পরিক কল্যাণকর সহযোগিতা দু’পক্ষের জন্যই সুফল বয়ে এনেছে। এ সময়, উচ্চ মানের উন্নয়নের পাশাপাশি, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো আফ্রিকায় সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে এনেছে; বন্দর, সেতু, ও সবুজ জ্বালানি খাতে বিভিন্ন সহযোগিতা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। আফ্রিকান অ্যাভোকাডো, তিল, চিনাবাদামসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য চীনে আমদানি হচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং সম্প্রতি ৫০ জন আফ্রিকান পন্ডিতকে লেখা এক জবাবি চিঠিতে বলেন, চীন ও আফ্রিকা সর্বদা অভিন্ন কল্যাণের সমাজের অংশ। চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)-র সিজিটিএন’র সম্প্রতি প্রকাশিত এক ইন্টারনেট জরিপের ফল অনুসারে, ৮৬.৩ শতাংশ আফ্রিকান উত্তরদাতা আফ্রিকার সাথে সহযোগিতায় চীনের আন্তরিকতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাঁরা বলেছে, এ সহযোগিতা থেকে বাস্তব ফলাফল অর্জিত হয়েছে ও হচ্ছে এবং দু’পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক সখ্যতা ও বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে ও হচ্ছে। তাঁরা নতুন যুগে চীন-আফ্রিকা অভিন্ন কল্যাণের সমাজ গড়ে তুলতে আগ্রহী। বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের শীর্ষ সম্মেলন, যৌথভাবে আধুনিকায়নের কাজকে এগিয়ে নিতে এবং উচ্চ মানের চীন-আফ্রিকা অভিন্ন কল্যাণের সমাজ গড়ে তোলার জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আফ্রিকা সংবাদ মাধ্যম বলছে, এবারের শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে টেকসই ও পারস্পরিক কল্যাণকর চীন-আফ্রিকা সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। বিগত ২৪ বছরে চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের সদস্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫টিতে। চীন ও আফ্রিকান দেশগুলো জাতির মুক্তির জন্য লড়াইয়ে পরস্পরকে সহায়তা করেছে। দু’পক্ষ আধুনিকায়ন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিন্ন স্বার্থ সুরক্ষা, এবং আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বর্তমানে চীন সার্বিকভাবে চীনা বৈশিষ্ট্যময় আধুনিকায়নের পথে হাঁটছে এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন পরিকল্পনা ২০৬৩ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। দু’পক্ষ যৌথভাবে আধুনিকায়নের জন্য কাজ করে গেলে, উচ্চ মানের চীন-আফ্রিকা অভিন্ন কল্যাণের সমাজ গড়ে তোলা সহজ হবে। সম্প্রতি চীন সরকার ‘চীন-আফ্রিকা বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত দশ বছরে আফ্রিকায় চীনা প্রতিষ্ঠান গুলোর চুক্তিবদ্ধ প্রকল্পের মূল্যমান সাত'শ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো থেকে নয়'শ মিলিয়নেরও বেশি আফ্রিকান মানুষ উপকৃত হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র ২০তম কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় অধিবেশনে,'সিপিসির সংস্কার আরও ব্যাপকভাবে গভীরতর করা এবং চীনা বৈশিষ্ট্যময় আধুনিকায়ন এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত’ গৃহীত হয়। ব্যাপকভাবে নতুন শিল্প উন্নয়ন, ভবিষ্যতের শিল্প ব্যবস্থাপনা, ঐতিহ্যগত শিল্পের রূপান্তর, এবং উৎপাদন-শিল্পের উচ্চ পর্যায়ের এবং বুদ্ধিমান ও সবুজ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার কথা বলা হয়েছে এই প্রস্তাবে। নতুন মানের উৎপাদন-শক্তি খাতের উন্নয়নের সাথে সংস্কারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবস্থা, এবং প্রতিভা অন্বেষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। উচ্চমানের বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি, একটি ভালো আন্তর্জাতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। আরও সংস্কারের মাধ্যমে নতুন মানের উৎপাদন-শক্তির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে।চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনের বড় আকারের উচ্চ-প্রযুক্তি উত্পাদন শিল্পের সংযোজনমূল্য বার্ষিক ৮.৭ শতাংশ এবং উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পে বিনিয়োগ বার্ষিক ১০.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্যের প্রবাহ, সফ্টওয়্যার এবং তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা শিল্প দ্বারা উপস্থাপিত আধুনিক পরিষেবা শিল্পের অতিরিক্ত মূল্য দ্বি-অঙ্কের বৃদ্ধি বজায় রেখেছে। ব্রিটেনের লন্ডন অর্থনীতি ও বাণিজ্য নীতি বিভাগের সাবেক প্রধান সম্প্রতি এক প্রবন্ধে বলেছেন, চীন নতুন মানের উৎপাদন-শক্তির উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। ফলে, চীনা পণ্য আরও ভালোভাবে বিশ্বের শিল্প ও সরবরাহ চেইনের সাথে সংযুক্ত হবে; চীনা অর্থনীতি আরও গভীর ভাবে বিভিন্ন অর্থনীতির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এর মাধ্যমে চীনের উদ্ভাবনশক্তি ও অর্থনীতির মান উন্নত হবে এবং বিশ্বের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে নতুন চালিকা শক্তি যুক্ত হবে।বিশ্বের বৃহত্তম নবায়নযোগ্য শক্তির বাজার ও সরঞ্জাম উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে, চীন অব্যাহত ভাবে বিশ্বকে বৈশিষ্ট্যময় পণ্য সরবরাহ করবে এবং বিশ্বের সবুজ ও নিম্ন কার্বন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে, এমন আশা করাই যায়। তাছাডাও চীন নতুন শক্তি প্রযুক্তি এবং পণ্য সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, পরিচ্ছন্ন শক্তি এবং সবুজ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার মধ্যে ৩০টি সৌর শক্তি উদ্যোগ রয়েছে। উপরন্তু, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং পরিচ্ছন্ন শক্তির ব্যবহার সম্পর্কিত সেমিনার এবং যৌথ গবেষণা প্রকল্প পরিচালনার জন্য আলোচনা চলছে। চীনের বাস্তুবিদ্যা ও পরিবেশ মন্ত্রক বুরুন্ডির সাথে "লাইটিং আফ্রিকা" প্রকল্পের জন্য একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা স্বাক্ষর করেছে। এই প্রকল্পটি জলবায়ু-বান্ধব 'ফটোভোলটাইক প্লাস' প্রকল্প নির্মাণ এবং জলবায়ু ও ফটোভোলটাইক উন্নয়নের উপর কথোপকথন এবং বিনিময় প্রচারের মাধ্যমে আফ্রিকান অঞ্চলে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ অ্যাক্সেসের সমস্যা সমাধানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। তাছাড়া চীনা কোম্পানিগুলো আফ্রিকায় সৌরশক্তি প্রকল্পে অগ্রসর হচ্ছে। যেমন, শেনজেন নোমো কর্পোরেশন, স্থানীয় অংশীদারের সাথে সহযোগিতায়, নামিবিয়াতে ৩,২০০টি সৌর-চালিত আলো ইউনিটের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা ঐতিহ্যগত কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর দেশের নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সমবায় প্রকল্পগুলি শুধুমাত্র আফ্রিকান দেশগুলির জন্য শক্তির অ্যাক্সেস যোগ্যতা এবং ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে সেট করা নয় বরং স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশ সুরক্ষা,সবুজ এবং কম-কার্বন-উন্নয়ন অর্জনকে উদ্দীপিত করার জন্য প্রস্তুত। চীন আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। আফ্রিকার দেশগুলোর এক-চতুর্থাংশ রপ্তানি পণ্য প্রধানত খনিজ, জ্বালানি এবং ধাতু চীনের বাজারে প্রবেশ করছে।একই সঙ্গে বেইজিং আফ্রিকার দেশগুলোর বৃহত্তম ঋণদাতাও। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আফ্রিকায় প্রভাববিস্তার করতে চাইছে বেইজিং।এরই ধারাবাহিকতায় জিনপিংয়ের এই মন্তব্য। এছাড়া চীনে যখন জনসংখ্যা সংকট এবং অর্থনীতি ধীর হয়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো ঘটছে, তখনই দেশটি আফ্রিকায় তার প্রভাব বাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। যা চীন-আফ্রিকার ডিজিটাল অর্থনীতিকে যেমন সচল করবে তেমনি সবুজ উন্নয়নে অবদান রাখবে। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য। ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |