শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতির উন্নয়নের চাবিকাঠি তারুণ‌্য
মো.হাছিবুল বাসার মানিক
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:৪১ পিএম আপডেট: ২৪.০৯.২০২০ ১২:৫৪ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

একটি সুন্দর ও মানুষের বসবাসযোগ্য জনপদ গড়ে তুলতে সমাজের যে অংশ সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তা হল তরুণ সমাজ। কালের পরিক্রমায় সমাজের তরুণরাই সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, রাহাজানি, শোষণের বিরুদ্ধে সবার আগে প্রাণের পরোয়া না করে রুখে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের সাধ্যমত সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রাণপণ লড়াই করেছে। তরুণরাই আগামী দিনের দেশ ও জাতির উন্নতির পথপ্রদর্শক। তারুণ্যের প্রবল প্রাণশক্তি যেকোন জাতির উন্নতির মূল সোপান।

লেখক: মো.হাছিবুল বাসার মানিক

লেখক: মো.হাছিবুল বাসার মানিক

তরুণদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনায়, কাজেকর্মের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন। পৃথিবীতে যুগে যুগে যত বিপ্লব হয়েছে, যুগে যুগে যত সফল আন্দোলন হয়েছে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তরুণরা নেতৃত্বদান করেছে। তরুণদের এই অকুতোভয় প্রয়াস ও হার না মানার মানসিকতাই সমাজ, দেশ বা রাষ্ট্রের কল্যাণে ভূমিকা রাখে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানাবিধ কারণে তরুণ সমাজ আজ বিপদগ্রস্ত, প্রভাবিত।

সামাজিক মাধ্যমের বহুল ব্যবহার

কয়েক দশক আগেও দৈনন্দিন জীবনে যখন আধুনিক প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য ব্যবহার ছিল না, তখন তরুণেরা দল বেঁধে আড্ডা দিত, ঘুরে বেড়াত, মাঠে খেলাধূলায় অংশ নিত। কিন্তু এখন তারা ঘরে বসেই স্মার্টফোনের পর্দায়, কম্পিউটারের মনিটরে চোখ বুলিয়ে দিনের অধিকাংশ সময় কাটায়। তাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম এখন ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মত বহুল আলোচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম৷ সেখানে তারা প্রতিদিন নিজেদের মহামূল্যবান সময় ব্যয় করছে, পরিচিত-অপরিচিত বহু মানুষের সাথে কথা বলছে৷ এর ফলে ব্যক্তির বাস্তবিক যোগাযোগ ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ বজায় রাখার কারণে মানুষের আবেগ-অনুভূতির জায়গায় ব্যাপক পরিবর্তন আসছে৷ ফলে তা মানুষের ব্যক্তিজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেকের কাছেই রীতিমত নেশার মত। যখন তরুণরা এসব মাধ্যম ব্যবহার করতে শুরু করে, তারা রীতিমত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়৷ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রেখে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেটা ব্যবহার করতেই থাকে। অনেকাংশে গভীর রাত জেগে তারা এটা ব্যবহার করে, যার ফলে তারা ক্লাসে নিয়মিত হতে পারে না, তাদের ফলাফল আশানুরূপ হয় না। এর পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যহানি তো ঘটেই। নিয়মিত খেলাধুলা ও শরীররচর্চার বদলে এসব বদঅভ্যাস গড়ে উঠায় অধিকাংশ তরুণের শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস পায়।

অবাধ প্রতিহিংসাপরায়ণতা

আমরা সবাই কিন্তু নিজের মনের ভাব অন্যের কাছে সুন্দরভাবে গুছিয়ে প্রকাশ করতে পছন্দ করি৷ আগেকার দিনে এই অভ্যাসটা শুধুমাত্র বাস্তবজীবনেই সীমাবদ্ধ ছিল যা বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রচলিত। কিন্তু বাস্তবে অনেক কিছুই ঘটে থাকে তার সঠিক ব্যাখ্যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যায় না৷ অনেক ক্ষেত্রে নানা ধরনের অপপ্রচার, গুজব মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক, টুইটার এর মত বহুল ব্যবহৃত মাধ্যমগুলোতে। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার কারণে এখন সবার হাতে হাতেই মোবাইল ফোন, ফলে এসব মিথ্যা খবর দ্বারা আমরা অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছি। ভুল পথে চালিত হচ্ছি, অন্যের প্রতি ভুল মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে ফলে অনেকেই ভুলবশত প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে৷

সাইবার নিরাপত্তা ও বিভ্রান্তিকর মদদদাতা

একজন তরুণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর নানাবিধ নিরাপত্তাজনিত বিষয় থাকে৷ মিথ্যা তথ্য ও গুজবে বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়াও তারা সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে কিংবা সাইবার অপরাধের শিকার-ও হতে পারে। যেকোন সাইবার অপরাধের শিকার হলে এর প্রতিকারের জন্য যেসব কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলো গ্রহণ করার কোন বিকল্প নেই।
সাইবার অপরাধের পাশাপাশি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন অসহিষ্ণু গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণা দেখা যায়। এছাড়াও আত্নগোপন করে থাকা অজস্র উগ্র মতবাদে বিশ্বাসীদের দ্বারাও অনেক তরুণরা প্রভাবিত হতে পারে। এর মূল কারণ হচ্ছে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো ধরনের তথ্য কিংবা সংবাদের সত্যতা, যথার্থতা যাচাই করার মানসিক পরিপক্বতা অধিকাংশ তরুণের মধ্যেই না থাকা। তারা ভাল-খারাপের মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করতে পারে না ফলে খুব সহজেই তারা এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হয়, ভুল পথে চালিত হয় যা তাদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।

বেকারত্বের নিষ্ঠুরতা

বর্তমানে তরুণ সমাজের মুষ্টিমেয় অংশ বেকারত্বের নির্মমতার শিকার যা জীবনের জন্য এক নিষ্ঠুর অভিশাপ। বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষের হার গত দুই এক দশকে অনেক বেড়েছে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শিক্ষিত বেকারের হার। এর পেছনে হাজারো রকমের কারণ রয়েছে। তবে এর মধ্যে প্রধান কিছু কারণ খুঁজতে গেলে বলা যায়, যুগের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেভাবে আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি। এছাড়াও গতানুগতিক চাকরি বা পেশা যতটা গুরুত্ব পায় তরুণ উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টা ততটা গুরুত্ব পায় না।

মাদকের ভয়াবহতা

জীবনে চলার পথে হাজারো বাধা-বিপত্তি আসে। অনেক কাজের সুষ্ঠু ফল পাওয়া যায় না। ব্যর্থতার গ্লানি তরুণরা মন থেকে সহজে মেনে নিতে পারে না। ফলে তারা হতাশায় পর্যুবসিত হয়ে পড়ে। নানাবিধ কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে এর ফলস্বরুপ দেশের অসংখ্য তরুণ হতাশা কাটাতে মাদকের ভয়ংকর পথ বেছে নেয়। মাদকাসক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে শুধু যে তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন হয় তা না বরং এতে তাদের পরিবার, সমাজও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

মাদকাসক্ত তরুণেরা ব্যক্তিগত জীবনে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের মন-মেজাজের হুটহাট পরিবর্তন ঘটে, ঘুম ও খাওয়া-দাওয়ার কোন রুটিন থাকে না। ফলে শারীরিকভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে, ফলে বিভিন্ন অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সঙ্গদোষে অন্যরাও এ ধরনের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

নিজেকেই উদ্যোগী হতে হবে

আধুনিক বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য যে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা দরকার, তা গড়ে উঠছে না। এর দায় সকলের। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতা মেনে নিতেই হবে। তবে তার জন্য নিজে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আমাদের উন্নয়নের মহাসড়কে অন্যদের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে নতুন জ্ঞান তৈরির মিছিলে শামিল হতে হবে। আর নতুন জ্ঞান তৈরি করতে পারলে, তার ব্যবহার বাড়াতে পারলেই আমরা আমাদের তরুণ সমাজের ইচ্ছে আর সক্ষমতার পার্থক্য ঘুচাতে পারব। আর তাহলেই আমাদের বেকার সমস্যার সমাধান হবে।

বর্তমান যুগে অর্জিত একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন করাও অতীব জরুরি। সেই দক্ষতা হতে পারে নিজের পড়াশোনার বিষয়ের সাথে জড়িত সফটওয়্যার ব্যবহার জানা, অফিসিয়াল কাজের জন্য বহুল ব্যবহৃত যেকোন সফটওয়্যার ইত্যাদি। এছাড়াও আজকাল ফ্রিল্যান্সিং পেশা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যারা ৯টা-৫টা অফিস করার চেয়ে বাড়িতে বসেই কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তাদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং পেশা অত্যন্ত উপযুক্ত। লোগো ডিজাইন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ফটো এডিটিং, ভিডিও এডিটিং, প্রুফ রিডিং, কন্টেন্ট রাইটার ইত্যাদি যেকোন ক্ষেত্রে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে পারলে ফ্রিল্যান্সিং জগতে নিজেকে প্রমাণ করা সম্ভব।

মাদককে না বলতে শেখা

মাদকাসক্তির মত একটি সামাজিক ব্যাধি তরুণ সমাজের জন্য হুমকিস্বরুপ। তরুণদের আলোর পথে অগ্রসর হতে এ এক বিরাট বাধা। তাই তরুণদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতির স্বার্থেই মাদকের ভয়াল থাবা থেকে তাদের বাঁচাতে হবে। সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে অচিরেই মাদক সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যকলাপ নির্মূল করা সম্ভব হবে।

আমাদের দেশের তরুণরা মেধায়, বিদ্যা-বুদ্ধিতে মোটেও বিশ্বের অন্য কোন দেশের তরুণদের চেয়ে কম নয়। তাদের মধ্যে অমিত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। শুধু দরকার প্রয়োজনমত সেই মেধার স্ফুরণ।

তরুণ সমাজ সম্ভাবনাময় এক আগামী নির্মাণের আলোকবর্তিকা। সুন্দর, সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রতিটি তরুণের সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক জীবনব্যবস্থায় বিপথগামী হওয়ার, নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হওয়ার অসংখ্য উপকরণ রয়েছে। কিন্তু নিজের কল্যাণের স্বার্থেই তরুণদের ভুল-ভ্রান্তির পথ থেকে সরে আসতে হবে। তরুণরা নিজেদের সার্বিক উন্নয়ন ঘটিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত হতে পারলেই তারা এক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে।

 মো.হাছিবুল বাসার মানিক
                                                                                                শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 


ডেল্টা টাইমস্/সিআর/জেডএইচ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬১, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬১, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com