নিয়মিত হাত ধোয়া কোভিড-১৯ মোকাবিলার অন্যতম উপায়
মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান
|
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস (Global Handwashing Day) ১৫ অক্টোবর পালন করা হয়। বিভিন্ন রোগের বিস্তার রোধে জনসাধারণের মধ্যে হাত ধোয়া বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্য এটি একটি প্রচারণামূলক দিবস। সুইডেনের স্টকহোমে ২০০৮ সালে বিশ্ব পানি সপ্তাহ উদযাপন অনুষ্ঠানে গ্লোবাল হ্যান্ড ওয়াশিং পার্টনারশিপের উদ্যোগে ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’ উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর দিনটি উদযাপনের বিষয়টি অনুমোদন করে। এরপর থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিবসটি সচেতনতার সাথে পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Hand Hygiene for All’ যার বাংলা ভাবার্থ করা হয়েছে, ‘সকলের হাত সুরক্ষিত থাক’। সারা বিশ্ব যখন করোনা আক্রান্ত সেই সময় সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল হাত ধোয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে একটি নতুন ‘ডুডল’ প্রকাশ করেছে। গুগলের হোমপেজে প্রকাশিত এক ভিডিও’র মাধ্যমে হাত ধোয়ার পদ্ধতি দেখানো হচ্ছে। ডুডলটিতে প্লে বোটন চাপলেই ৫০ সেকেন্ডের অ্যানিমেশনের মাধ্যমে ছয় ধাপে কিভাবে হাত ধোয়া শেখানো হচ্ছে সেটা দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুলে করোনাভাইরাস মরে যায়। ওয়েলকম ওপেন রিসার্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় দিনে অন্তত ছয়বার হাত ধোয়ার মাধ্যমে ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হাত ধোয়ার উপর জোর তাগিদ ও নির্দেশ দিচ্ছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর অনেক আগে থেকেই হাত ধোয়া শিখানোর কর্মসূচি পালন করে। যার ফলে এবার কোভিড-১৯ থেকে জনগণের প্রাণ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৩৬ সালে সৃষ্ট এই পুরনো অধিদপ্তর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই প্রতিবছর স্কুল কলেজ ও সাধারণ মানুষের হাত ধোয়ার জন্য সেমিনার, র্যালিসহ সামাজিক কর্মকাণ্ড করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে আসছে। সারাদেশে প্রতিবছর বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসে প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলগুলোতে হাত ধোয়া কর্মসূচি পালন করা হয়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ৪৯২টি উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ৫ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কোভিড-১৯ মোকাবিলাতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ৮টি, জেলা শহরে ৫টি এবং প্রতিটি উপজেলায় ১টি করে হাত ধোয়ার স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ইউনিসেফের সহযোগিতায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতি জেলায় ব্লিচিং পাউডার ক্রয় বাবদ ৫০ হাজার টাকা, নলকূপের খুচরা যন্ত্রাংশ বাবদ ৩০ হাজার টাকা এবং সাবান ক্রয় বাবদ ২০ হাজার টাকা অর্থাৎ জেলা প্রতি ১ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য প্রতি উপজেলায় নলকূপের খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় বাবদ ৩০ হাজার, ব্লিচিং পাউডার ক্রয় বাবদ ২০ হাজার এবং সাবান ক্রয় বাবদ ৫ হাজার টাকা অর্থাৎ উপজেলা প্রতি ৫৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাংক জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে হ্যান্ডওয়াশিং বেসিনে ব্যবহারের জন্য সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ক্রয় বাবদ ২ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। করোনাভাইরাস রোগের (কোভিড-১৯) বিস্তার কমিয়ে আনতে এবং নিজেদের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ শারীরিক দুরত্ব অনুশীলন করাসহ বিভিন্ন ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করছে। অনেক শিশু ইতোমধ্যে নিজেদের সুরক্ষার জন্য ভালোভাবে ও নিয়মিত হাত ধোয়ার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছে। বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের জন্য পানি বা স্যানিটেশন সুবিধাদি প্রথম দিকে তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। বড়ো রোগের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ) সম্পর্কিত সেবাসমূহ চালু’র ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি ইউনিসেফ ও অন্যান্য অংশীদাররা দ্রুততার সাথে এগিয়ে আসে। এছাড়াও, ২০১৯ সালের শেষের দিকে ইউনিসেফ প্রায় ২,৫০০ শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিল। প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রে হাত ধোয়ার জায়গা ছিল। হাত ধোয়ার জায়গায় সাবান ও পরিস্কার পানি সরবরাহ করা হতো। যার ফলে সঠিকভাবে হাত ধোয়ার উপায়সহ সুস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত পাঠ আগেভাগেই কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শিশুর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। ইউনিসেফ তার ওয়াশ কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। এর মাধ্যমে ২ লক্ষ ৪০ হাজার শরণার্থীর অর্ধেকেরও বেশি শিশুর জন্য নিরাপদ পানি ও সাবান সরবরাহ করা হয়েছে। অভিন্ন টয়লেট, গোসলখানা ও টিউবওয়েলের মতো পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও হাইজিন অবকাঠামোগুলো অনেকে মিলে ব্যবহার করায় জটিলতা ও চ্যালেঞ্জগুলো অনেক বেড়ে যায়। যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার মধ্য দিয়ে কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধের সুযোগ তৈরি হয়। মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার আওতায় নিয়ে আসা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করাই বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসের মূল লক্ষ্য। মূলত স্কুলের শিক্ষার্থীরাদের টার্গেট করে এ ক্যাম্পেইন শুরু হলেও পরে বিশ্বজুড়ে সব বয়সি মানুষের মধ্যে সাবান দিয়ে সঠিকভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগ-প্রতিরোধের মাধ্যমে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনাই এ প্রচারণার অন্যতম উদ্দেশ্য। সঠিকভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে এবং এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এগুলো প্রচার করতে হবে। ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও হাত ধোয়ার ওপর ইদানিং যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে এবং এর পক্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও চলছে। আমরা নানারকম জিনিস হাত দ্বারা ধরে থাকি, এতে নানা রোগের জীবাণু থাকতে পারে। হাত না ধুয়ে নাক, মুখ স্পর্শ করা হলে এসব জীবাণু সহজেই নাক, মুখ ও কানের মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশ করে দেহকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত করতে পারে। হাত ধোয়ার জন্য নিরাপদ পানি দরকার। আমাদের পানিপ্রাপ্তির উৎসগুলো প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। কেবল বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে দুনিয়াজুড়ে পানিবাহিত রোগে মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যেতে পারে। প্রতিবছর গরমকালের শুরুতে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। চিকিৎসকদের মতে মূলত দূষিত পানি পান করার কারণে এটা ঘটে। জাতিসংঘ বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৫টি দেশে পানি দুর্লভ হয়ে পড়বে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের রিপোর্ট মতে, ২০১২ সালে ১০০ কোটির বেশি মানুষ নিরাপদ পানির সংকটে ভুগেছিল। ২০ বছর পরে বাংলাদেশের ১০ কোটিসহ বিশ্বের কমপক্ষে ৪০০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে নিপতিত হবে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৬.২ এর লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘ নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। সকলের দোড়গোড়ায় স্যানিটেশন সুবিধা পৌঁছে দিতে হাইজিন প্রসারের জাতীয় কৌশলপত্র-২০১২, সেক্টর উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০১১-২৫ সহ বাস্তবমুখী বিভিন্ন কৌশলপত্র ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় ও এর বিস্তার রোধের সবচেয়ে সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর উপায়গুলোর একটি হলো নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো সঠিকভাবে মেনে চলা। সুন্দর জীবন ও সুস্থতার জন্য প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস অত্যন্ত জরুরি। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের সরকারের সময়োপযোগী কার্যক্রম গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। (পিআইডি ফিচার) ডেল্টা টাইমস্/মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান/সিআর/জেড এইচ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |