সেদিনের অকাল মৃত্যুর ঘটনা আজো ভুলিনি
রহমান মৃধা
|
২ আগস্ট ১৯৮৪ সাল। সেদিন বিষাদ গ্রাস করেছিল আকাশময়। নিঃস্তব্ধ আর্তনাদ ফুপিয়ে ফুপিয়ে উঠেছিল আমাদের জেলা মাগুরার ছোট্ট গ্রাম নহাটায় নিজ ঘরময়, লম্বা বারান্দা থেকে শুরু করে সমগ্র উঠান জুড়ে। প্রিয়মুখ হারানোর শংকায় মা কোরআন শরীফ তেলওয়াত করে চলেছিলেন ক্রমাগতভাবে স্রষ্টার কাছে নিজ পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা করে। একটি ভুলের কারণে এমন একটি ক্ষতি হতে পারে না। সেদিন বাবা, মা, ভাই, বোনের কান্নার রোল উঠেছিল আকাশে, বাতাসে, জলে, স্থলে। মনে হয়েছিল পুরো পৃথিবীই অন্ধকার হয়ে গেছে দিনে দুপুরে। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হোক। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ী সেই ফরিয়াদে খোদা তার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করেননি! “what is looted cannot be blotted”! আমার এইচএসসি পরীক্ষা সবেমাত্র শেষ হয়েছে। চলছে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান চালক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতিপর্ব, ওদিকে চলছে ইংরেজি ভাষার টোফেল পরীক্ষা, সব মিলে আমি খুব ব্যস্ত সেই ব্যস্ততম নগরী ঢাকাতে। অ্যারোফ্লোটের ম্যানেজার মাহবুব হোসেনের বাসাতে আছি, দুঃসম্পর্কে তিনি আমার ভাই হন। আমার মেঝো ভাই, কর্নেল (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) হান্নান মৃধা, তাঁর ট্রেনিং চলছে তখন চট্টগ্রামে। হঠাৎ তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, 'আমি ঢাকাতে আসছি তুমি তৈরি থেকো, রাতের বাসে আমরা নহাটাতে (মাগুরা জেলা) যাব।' কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করছি, কী জন্য হান্নান ভাই চট্রগ্রাম থেকে ঢাকা আসছেন এবং আমাকেই বা কেন বাড়িতে যেতে হবে! কিছু দুঃশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল মনের মাঝে সারাদিন। হান্নান ভাই ঢাকাতে পৌঁছাতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল, গুলিস্তান থেকে বাসে করে রওনা দিতেই শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টি। আরিচা ঘাটে পৌঁছাতেই ফেরি পেয়ে গেলাম। ভয়ংকর পদ্মা নদীর পারাপারে সেই ভয়াবহ ঝড়বৃষ্টির কথা আমি আজও ভুলিনি। রাত তখন গভীর, দুই ভাই বাস থেকে নেমে চলমান ফেরির অভ্যন্তরে ফেরির ভেতরে বসে কথা বলতেই হান্নান ভাই কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কিছুটা অবাক। ভাইয়ের চোখে জল এবং বলছেন 'নিশ্চিত ভুল খবর পেয়েছি, সৈনিক নিশ্চিত ভুল শুনেছে'। একজন সৈনিক তার বাড়ি আমাদের এলাকাতে সে সেদিনই নহাটা থেকে খবরটি শুনেছিল এবং মাগুরা থেকে ফোন করে হান্নান ভায়ের ইউনিটে খবরটি রেখেছিল। ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর আমাদের প্রিয় সহোদর সেলিমের মৃত্যু হয়েছে! সেলিম আমার ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক দারুণ মেধাবী ছাত্র। মনটা ভেঙ্গে গেলো, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চলতে চলতে শেষে আমরা পর দিন বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল গড়িয়ে দুপুরে পরিণত হয়েছিল। ওদিকে বাবা আমাদের জন্য দেরি করেছিলেন তিন তারিখ সকাল অব্দি! পরে বেলা ১০-১১ টার দিকে সেলিমের জানাযার কাজ শেষ করা হয়। আমরা তার লাশ কবর দিতে পারি নাই, মৃতের কবর জেয়ারত করেছিলাম বাড়িতে এসে। সেই রাতে বিদ্যুৎ সংযোগের ছোঁয়ায় অন্ধকার ঘরে বাতি জ্বলেছিল, কিন্তু এই ছোঁয়ায় যে প্রাণ প্রদীপ নিভে গিয়েছিল সেই আঁধারময় বেদনা আজও আমাদের পরিবারকে অন্ধকার করে রেখেছে। সেই প্রাণপ্রদীপ আর জ্বলে উঠেনি! নহাটায় সবেমাত্র বিদ্যুৎ এসেছে। সেদিন বাড়িতে বিল্ডিংয়ের কাজ চলছিল। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ একটি চিৎকার শুনতে পেয়ে আমার দুই ভাই সেলিম এবং শাহিন দু’জনই দৌড়ে গিয়ে দেখে চুন্নু নতুন বাড়ির ভেতরে একটি বাঁশের সঙ্গে আটকে কাঁপছে আর চিৎকার করছে। চুন্নুকে বাঁচাতে সেলিম তাকে টান দিয়ে বাঁশ থেকে সরায়। কিন্তু সে নিজে যে অন্য একটি বাঁশের সঙ্গে আটকে পড়ে তা কারো নজরেই পড়েনি! কারণ হঠাৎ চুন্নুকে নিয়ে শাহিন, বাবা-মাসহ অন্যরা সবাই কিছু সময়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মুহূর্তটি ছিল খুবই স্বল্প সময়। সেলিম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, কিন্তু কেন? কী জাদু ছিল সেদিনের সেই বৃষ্টি ভেজা বাঁশে? বাংলাদেশের স্থাপনা নির্মাণে ছাঁদ তৈরির সময় বাঁশ ব্যবহার করা হয়ে থাকে ছাদের সাপোর্ট হিসেবে। আচমকা বিদ্যুতের তারের সঙ্গে কাঁচা বাঁশের খুঁটির সংস্পর্শে এমন ঘটনাই ঘটেছিল সেদিন। কেউ জানত না যে বৃষ্টি ভেজা প্রত্যেকটি বাঁশের খুঁটিতে বিদ্যুৎসংস্পর্শ এভাবেও প্রাণ কেঁড়ে নিতে পারে! ল্যাক অফ সেফটি অ্যান্ড ল্যাক অফ ইনস্টলেশন ছিল সেদিনের সেই ট্রাজেডির জন্য দায়ী। অবাক! হিমুর মুখে খাবার নেই! সেও নিঃস্তব্ধ নীরবে সবার মধ্যে ঘুরছে! তার মধ্যেও এমনটি শোকের বন্যা সঙ্গে ভালবাসা গড়ে উঠেছে। হিমু আমাদের বাড়ির ছাগলটা, তার জন্ম আমাদের বাড়িতেই এবং জন্ম থেকেই সে সবার স্নেহ ভালোবাসায় গড়ে উঠেছে। মনে হচ্ছিল অনুভূতি আর ভালোবাসা সেদিন নতুন করে এসেছিল সবার জীবনে। ক্ষণিকের তরে ভাই-বোন যারা বাড়িতে সবাই এক নতুন বন্ধনে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। ওদিকে আমাদের বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা তিনি তখন সুইডেনে, এবং এ ঘটনার কিছুই তিনি জানেন না। নহাটা থেকে চিঠিতে সব খবর বড় ভাইকে জানিয়ে ফিরে এলাম ঢাকাতে। দু’সপ্তাহ কেটে গেল হঠাৎ মাহবুব ভাইয়ের বাড়িতে ভোর রাতে ফোন এলো নতুন করে কাঁন্নার রোল বয়েছিল সেদিন স্টকহোম থেকে, মান্নান ভাই ঐদিনই চিঠিটা পেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন 'সামান্য ২০ গ্রাম ওজনের একটি চিঠি, একটি খবর যা আজ ২০ টন ওজনের বেদনা হৃদয়ের ওপর চাপিয়ে দিল'! ২রা আগস্ট, ১৯৮৪ থেকে ১৮ মে ১৯৮৫ সময়টুকু ছিল জীবনের কিছু সময় যা জীবনযুদ্ধের হারজিতের সময়। ট্রাজেডি, যা চলে গেছে তা নিয়ে ভাবা, নাকি যারা বেঁচে আছে তাদের নিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার আশা, এ ছিল এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া! বিশেষ করে শাহিনের জন্য সময়টা ছিল বেশি কষ্টের কারণ সেলিম ও শাহিন ওরা ছিল বয়সে পিঠাপিঠি দুই ভাই। মূহূর্তটি ছিল সেলিমের জন্য ১০০% ডেডিকেশন, অফারিং ও সাফারিংয়ের। সে তার জীবন উৎসর্গ করেছিল আরেক ভাইকে বাঁচাতে সঙ্গে রেখে গেল ভালোবাসা ও মানবতার বেস্ট প্রাকটিসের ওপর লেসন ল্যার্ন্ড। যাই হোক ১৯৮৫ সালের ১৯শে মে আমার নতুন জন্ম হলো সুইডেনে। সেই থেকে এখানেই আছি। আমার বিশ্বভ্রমণের সঙ্গে নিজের দেশেও গিয়েছি তিনবার, তবে বাংলাদেশকে ভালোবাসি এতো বেশি যে নিঃশ্বাসে, বিশ্বাসে, পলকে, ঝলকে সে রয়েছে স্বপনে ও জাগরণে লতার মতো জড়িয়ে যা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মতো। কারণ সেখানে রয়েছে ভাই, বোন, বাবা, মায়ের সবার স্নেহ। কেন আজ হঠাৎ এসব পুরনো কথা? কারণ এমন একাধিক আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা, নানামুখী বৈদ্যুতিক ব্যবহার বেড়েছে দেশে। বেড়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা দিনের পর দিন। কিন্তু বাড়েনি সচেতনতা ও সতর্কতা। গত মাসে একটি লেখা দিয়েছিল মাগুরার এক সাংবাদিক নাম আসিফ কাজল। সে আমার ইনবক্সে পোস্ট করে ও মতামত প্রত্যাশা করেছে। কেন জানি না? সে কি জানতে পেরেছিল আমাদের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনাটি যা ঘটেছিল ১৯৮৪ সালে? নাকি আমি যেহেতু দেশের যা অনিয়ম, অসাবধানতা বা যা ভালো এবং শিক্ষামূলক সচরাচর শেয়ার করে থাকি বা একটু লেখালেখি করি তাই আমার মতামত জানতে চেয়েছিল! আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি, তবে জাস্ট ছোট্ট একটি কমেন্টস করেছিলাম পরিবারের প্রতি তাদের দুঃখের সাথী হয়ে। অনেক চিন্তার পর হাত দিয়েছি সেই পুরনো দিনের কথায়! ১৯৮৪ সাল পার হয়ে আজ ২০২১ সাল অথচ এতো বছর পরেও ডিজিটালের যুগে এখনও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বসানো বা সংযোগের অসুবিধার কারণে মৃত্যু ঘটতে পারে তাও বাংলাদেশে? যেখানে বিরাট আকারে জোর দেওয়া হয়েছে ডিজিটালাইজেশনের ওপর, এমনকি স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে মহাশূন্যে! অথচ জাতির মৌলিক নিরাপত্তা ইসূ অর্থাৎ সেফটি কনসেপ্টের ওপর প্রশিক্ষণটি আজও পৌঁছেনি সে দেশের সাধারণ জনগণের মাঝে! ইনফরমেশন টেকনোলজি শুধু কাগজে কলমে হলে হবে কি, যদি তাকে সুশিক্ষার আলোর নিয়ন্ত্রণে এনে ভালো প্রশিক্ষণ না দেওয়া হয়? সুশিক্ষার মধ্যদিয়ে ডিজিটালের ব্যবহার পদ্ধতিকে ইমপ্লিমেনটেশন করা এবং জাতির জন্য সেফটি রিজন ইন প্লেস হোক ডিজিটালাইজেশনের মূল লক্ষ, সেই সঙ্গে এলিমিনেশন করা হোক হাজারও অকাল মৃত্যু, এমনটি প্রত্যাশা দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে, তথা রাষ্ট্রের কাছে। লেখক: সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট) ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com ডেল্টা টাইমস্/রহমান মৃধা/সিআর/আরকে |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |