পাক-চীন পারমাণবিক সম্পর্কে ধাক্কা মার্কিন কালো তালিকাভুক্তি
শঙ্কর কুমার
|
পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছিলো চীন। বর্তমান পৃথিবীর কাছে আজ এটি এক উন্মুক্ত সত্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে পাকিস্তানকে পারমাণবিক অস্ত্রের পুরো নকশা দিয়েছিলো চীন। সেসময়, গোপনে ইসলামাবাদকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় রিং ম্যাগনেট সরবরাহ করেছিলো বেইজিং। তাই চীন-পাকিস্তান পারমাণবিক জোট বিশ্বের সকল সামরিক বিশেষজ্ঞের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত নাম। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক নিষেধাজ্ঞার ফলে এই জোটের অগ্রগতি একটি বিশাল ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিহীন পরমাণু কার্যক্রম অথবা দেশটির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগে চীন ও পাকিস্তানের ১৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এবং কিছু ক্ষেত্রে চীনা সামরিক বাহিনীর কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রচেষ্টায় সহায়তা করার অভিযোগে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়। ইতিহাস ঘাটলেই আমরা দেখতে পাই, নব্বই এর দশকের শুরুতেই পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক সক্ষম এম-১১ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কিত প্রযুক্তি পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছিলো চীন। কিন্তু এটি করতে গিয়ে মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম (এমটিসিআর) প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে তারা। সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশন দ্বারা প্রকাশিত এক প্রবন্ধে জন ডরি এবং রিচার্ড ফিশার উল্লেখ করেছেন, “ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়, পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা প্রকৃতপক্ষে চীনা ব্লুপ্রিন্টের উপর ভিত্তি করে তৈরী। ১৯৯০ এবং ৯২ সালে চীন পাকিস্তানকে পারমাণবিক সক্ষম এম-১১ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছিলো যার পাল্লা ১৮৬ মাইল। তাছাড়া, ৩৬০ মাইল রেঞ্জের মধ্যে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরীতে চীন পাকিস্তানকে প্রযুক্তিগত সহায়তা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।” এটি স্পষ্টতই এমটিসিআর নির্দেশিকা লঙ্ঘনের শামিল। এ কারণেই ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের প্রশাসন চীনের উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো। অতঃপর এমটিসিআর নির্দেশিকা মেনে চলার অঙ্গীকার করে নিষেধাজ্ঞার কবল থেকে মুক্ত হয় চীনা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সামরিক বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট মোতাবেক, চীন এই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। এটি এমটিসিআর নির্দেশিকার একটি সংকীর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে পাকিস্তানে পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তি হস্তান্তরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। এই শতাব্দীর শুরুতেই ২০০৪ সালে করাচিতে পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের জন্য পাকিস্তানকে প্রযুক্তি হস্তান্তর করে দেশটি। সবশেষ, গত ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সেস ঘোষণা দেয়, চীনের অপটিক্স এবং ইলেকট্রনিক্স ইনস্টিটিউট পাকিস্তানকে একটি শক্তিশালী ট্র্যাকিং সিস্টেম বিক্রি করেছে যা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বহু-ওয়ারহেড ক্ষেপণাস্ত্রের বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এরই সূত্র ধরে ২৭৫০ কিলোমিটার পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শাহিন-৩ এর প্রযুক্তি বিশ্লেষণ করেন সামরিক গবেষকগণ এবং চীনের ডিএফ-১১ এর ডিজাইনের সঙ্গে এর উল্লেখযোগ্য মিল খুঁজে পান। একই সময় মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত করে, পাকিস্তান একটি মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিএন্ট্রি ভেহিকেল সক্ষম মিসাইল আবাবিলের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। তাছাড়া, চীন পরে নিশ্চিত করেছে যে তারা এমআইআরভি সক্ষমতা বিকাশে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছে। তবে একটি বিষয় না বললেই নয়। পাকিস্তান ও চীনের এই হানিমুন কিন্তু বিগত বহু দশক ধরে অব্যহত রয়েছে। মাঝে কিছু সময় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কিংবা আন্তর্জাতিক চাপ এই হানিমুনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলেও পরক্ষণেই তা আরও শক্তিশালী রূপে দৃশ্যমান হয়েছে। এদিকে, সম্প্রতি গত ০৪ নভেম্বর পাক নৌবাহিনীকে একটি উন্নত ফ্রিগেট সরবরাহ করেছে বেইজিং। এখনও অবধি পাকিস্তানে সরবরাহ করা চীনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ এটি। এর আগে পাক সেনাবাহিনীকে আধুনিক ভিটি-৪ যুদ্ধ ট্যাঙ্কও হস্তান্তর করে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটি। পাশাপাশি জেএফ-১৭ থান্ডার ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট তৈরিতে একত্রে কাজ করছে দেশ দুটো। গতবছর নভেম্বরে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেংশে ইসলামাবাদ সফর করেন। এসময় আরও জোরদার হয় দু দেশের মধ্যকার প্রতিরক্ষা বন্ধন। সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর করে দেশ দুটো। উভয় রাষ্ট্রের সরকারই এই চুক্তিকে বিশেষ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এসআইপিআইআরআই ইয়ার বুক ২০২০ এর রিপোর্ট মোতাবেক, পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ১৬০ টি ওয়ারহেড রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা একে চীন ও পাকিস্তানের অপবিত্র জোটের ফসল বলে অভিহিত করেছেন। বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য এটি নিঃসন্দেহে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা এর রাশ কিছুটা হলেও টেনে ধরতে সক্ষম হবে। তবে কতোটা কার্যকরভাবে মার্কিন প্রশাসন গোটা বিষয়টি সামলাতেন পারে, সেটিই এখন দেখার। তবে বিবিসির বলছে, মার্কিন এই কালো তালিকাভূক্তি বিষাক্ত বাতাসে কিছুটা হলেও শান্তির বার্তা নিয়ে আসবে। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক অনুবাদ: ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল ডেল্টা টাইমস্/সিআর/আরকে |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |