খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে বানভাসি মানুষ
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে বানভাসি মানুষ কিন্তু এরপরই যেন প্রলয় শুরু হয়। পানি হু হু করে বাড়তেই থাকে। এর মধ্যেই বিদ্যুৎ, মুঠোফোন সেবা ও ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দেখতে দেখতে কোমর থেকে গলাপানিতে ভরে যায় ঘরগুলো। দিশেহারা মানুষের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এবারের বন্যায় সড়ক-রেল যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, মুঠোফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের পুরোটা এবং সিলেটের বেশির ভাগ এলাকা কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যা উপদ্রুত সুনামগঞ্জ ও সিলেটে ব্যাংক লেনদেন বন্ধ। দোকানপাট, হাটবাজারসহ অন্যান্য জনজীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। আবার ভাড়াও বেড়ে কয়েক গুণ হয়ে গেছে। অপরদিকে উত্তরে অবনতি হয়েছে বন্যার। বেড়েছে তিস্তা-ঘাঘট-যমুনাসহ বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি। এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে লালমনিরহাট-রংপুর- কুড়িগ্রাম-সিরাজগঞ্জসহ উত্তরের বেশিরভাগ জেলার নিচু এলাকা। ডুবেছে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট। ত্রাণ সংকটে বিপাকে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ।যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়তে থাকায় জামালপুরে বন্যার অবনতি হয়েছে। মাদারগঞ্জ-ইসলামপুর- সরিষাবাড়ী ও বকশিগঞ্জের অন্তত ১৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। পানি উঠায় ২৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জের পর নেত্রকোণার খালিয়াজুড়িতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। শেরপুরেও দুর্ভোগ কমেনি বানভাসী মানুষের। এদিকে, বৃষ্টিপাত কমলেও বানের জলে ভাসছে সিলেট। একই অবস্থা সুনামগঞ্জেরও। সীমাহীন দুর্ভোগে এ দুই জেলাসহ সারাদেশে বন্যাকবলিত লাখ লাখ মানুষ।যেসব জেলায় বন্যা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় তা দেশের কুড়িগ্রাম, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা থেকে প্রবেশে করে আরও এগিয়ে আসছে। ফলে জামালপুর, বগুড়া, শেরপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, লালমনিরহাট, নীলফামারি ও পাবনায় বন্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়া নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভিবাজারে বন্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে। বন্যার পানি আরও নীচের দিকে নেমে এলে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ইত্যাদি এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ২০১৩ সালের জরিপ থেকে জানা যায়,সবার জন্য উন্নত উৎসের পানি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ৯৭ শতাংশের বেশি মানুষের উন্নত উৎসের পানি পাওয়ার সুযোগ আছে, কিন্ত এই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারছি না এটা আমাদের জন্য অস্বস্তির মূল কারণ। তবে পুরোপুরি নিরাপদ পানি পানের সুযোগ এখনও সীমিত, মাত্র ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০০ সালের তুলনায় ২০১২ সালে আর্সেনিক যুক্ত পানি পানকারীর হার ২৬ দশমিক ৬ থেকে কমে ১২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এরপরেও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। অগ্রগতি সত্ত্বেও এক কোটি ৯৪ লাখ মানুষ এখনও সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। এছাড়া পানিতে ম্যাঙ্গানিজ, ক্লোরাইড ও লৌহ দূষণের কারণেও খাওয়ার পানির মান খারাপ থাকে। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ পানির উৎসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মলের জীবাণু রয়েছে এমন উৎসের পানি পান করছে ৪১ শতাংশের বেশি মানুষ। এক্ষেত্রে স্বল্প শিক্ষিত নগরবাসী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ২০১৩ সালের জরিপে বলা হয়েছে। শহরাঞ্চলের এসব পরিবারে যে পানি খাওয়া হয় তার এক তৃতীয়াংশেই উচ্চমাত্রার ই-কোলাই ব্যাক্টেরিয়া থাকে, যা ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, উৎস থেকে বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহের সময় এতে আরও বেশি ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া চলে যায়। প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে দুটি, অর্থাৎ বাংলাদেশের ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া দূষিত উৎসের পানি পান করে। আবার ঘরের কল বা টিউব-ওয়েলের আশপাশ পরিষ্কার না থাকায় বিভিন্ন অণুজীবযুক্ত পানি পানকারীর সংখ্যা হয়ে দাড়ায় নয় কোটি ৯০ লাখ। সারা দেশের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে পানি পয়ঃনিষ্কাশন ও হাইজিনের অবস্থা ভালো না হওয়ায় সেগুলো থেকেও জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয় এবং তা নবজাতক ও মাতৃ মৃত্যু হার কমানোর অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে যত নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে তার প্রায় ২০ শতাংশই হয়েছে জীবাণু সংক্রমণের কারণে। এছাড়া ঘনঘন বন্যা, ভূমিধ্বস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও পানির উৎস দূষিত হয়ে পড়ে। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে শৌচাগার উপচে ময়লা ছড়িয়ে পানির উৎস দূষিত হয়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অধিক সংখ্যায় মানুষ নগরমুখী হওয়ার কারণে এসবের সম্মিলিত প্রভাবে বাংলাদেশে পরিবেশগত দুর্যোগ ঘটে। শিল্পবর্জ্য, সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং জমিতে লবণাক্ত পানির কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণও বাংলাদেশে পানির গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অঞ্চলভেদেও পানির মানে উল্লেখযোগ্য অসমতার প্রমাণ পেয়েছে ইউনিসেফ।যেমন রংপুর বিভাগে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ ই-কোলাই ব্যাক্টেরিয়ামুক্ত পানি পান করে। সেখানে সিলেটে এ হার মাত্র ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। ধনী-দরিদ্র ভেদেও মানসম্পন্ন পানি পাওয়ার সুযোগে তফাৎ রয়েছে। ধনীরা নিজেদের বাড়িতেই খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে। অপরদিকে সরকারি বা অন্য কোনো উৎস থেকে পানি আনতে দরিদ্র মানুষরা আলাদা করে সময় আর শ্রম দিতে বাধ্য হয়। তাছাড়া নিরাপদ খাবার পানি এবং স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার অভাব শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, সুরক্ষাসহ অন্যান্য বিষয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের পাড়া-মহল্লার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ পানি সরবরাহ কার্যক্রম জোরদার করা খুবই জরুরী। ২০৩০ সাল নাগাদ দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য সুপেয় পানি প্রাপ্তির টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে ইউনিসেফ। কিন্ত কাজের কাজ কিছুই যেন এগুচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষের অপুষ্টির অন্যতম কারণ ডায়রিয়া এবং অন্ত্রে প্রদাহজনিত রোগ এড়াতেও সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গম অঞ্চলে কম ব্যয়ে সেবা দেওয়ার জন্য সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে ইউনিসেফ। যেমন ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে ইউনিসেফের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বস্তিগুলোতে বৈধ পানির সংযোগ দেওয়া সহজ হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার জমিতে লবণাক্ততা ঢোকা বন্ধে সমাধান বের করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করছে ইউনিসেফ। এছাড়া জলবায়ু সহিষ্ণু প্রযুক্তির প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা করার পাশাপাশি এ খাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে ইউনিসেফ। সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামলে নেওয়ার কার্যক্রমেও সমন্বয় করা হয়।নিরাপদ পানি নিশ্চিতের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার লক্ষ্যে আর্সেনিকমুক্ত ইউনিয়ন ও উপজেলাকে উদাহরণ হিসেবে সামনে এনে এক্ষেত্রে সমন্বিত মডেল তুলে ধরেছে ইউনিসেফ। সুতরাং তাদের সাথে সমন্বয় রেখে আমাদের কে এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান আকস্মিক বন্যার কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় কারও কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছিল না। এ কারণে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় এখন তীব্র খাদ্যসংকট চলছে। বেশির ভাগ মানুষেরই ঘরে থাকার উপায় নেই। আশ্রয়কেন্দ্রে সবার ঠাঁই হচ্ছে না। অনেকে ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে প্রতিবেশীর ঘরে কিংবা ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। প্রথম আলোর খবরে জানা যাচ্ছে, সিলেট শহরের আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতেই খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছে। বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় কম। আবার যা-ও বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, সেটাও যানবাহনের স্বল্পতায় পৌঁছানো যাচ্ছে না।সিলেট শহরের পরিস্থিতি যদি এমন হয়, তাহলে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা কী, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। এমনকি আশ্রয়শিবিরে অনেকের আশ্রয় মিললেও খাদ্য সহায়তা অপ্রতুল।আকস্মিক বন্যার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে এখন মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম। ঘরের শেষ অবলম্বনটুকু রক্ষা করতে মরিয়া মানুষ। সেগুলো নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য নৌকা প্রয়োজন। প্রচুর নৌকা প্রয়োজন। উদ্ধার ও ত্রাণের জন্য সেটা প্রয়োজন। উপদ্রুত এলাকায় যেমন মানবিকতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, আবার নির্মমতার ঘটনাও আমরা দেখছি। আবার ছড়িয়ে পড়েছে ডাকাতির আতঙ্ক।এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীজুড়েই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া এখন। কোথাও অতিবৃষ্টি, আবার কোথাও খরা। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এবার ১২৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে বৃষ্টি হয়েছে। উজানের নদীগুলোয় বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না, অথচ বন্যা মৌসুমে বাঁধের গেট খুলে দেওয়ায় ঢল নামে। বাংলাদেশের নদী, হাওর ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো দখল ও দূষণে আমরা প্রায় মেরে ফেলেছি। এরপর অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রকৃতিবিরুদ্ধভাবে বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ করেছি। পলিথিন ও পলিতে জলাশয়ের পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। বড় বন্যার পেছনে এমন বহু কারণ রয়েছে। কিন্তু এগুলো দীর্ঘদিনে হয়েছে। এ থেকে বের হওয়াটাও শিগগির সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিকল্প নেই। কিন্তু এ নিয়ে বিতর্কের বৃত্তে আটকে থাকাটাই যথেষ্ট নয়। বন্যায় লাখ লাখ মানুষের সামনে যে বড় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, সেটা এ মুহূর্তের প্রধান সংকট। সবাই মিলে সেটা মোকাবিলা করা জরুরি। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ এখন বাঁচার জন্য লড়ছে। অনেকে অভুক্ত, কেউ আধা পেট খেয়ে আছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট তীব্র। ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যাওয়ায় অনেকে স্থানীয় প্রশাসনের চালু করা আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েও পাচ্ছে না খাবার। তাই খাদ্য, সুপেয় পানি আর চিকিৎসার সামগ্রী দ্রুত পৌঁছানো না গেলে সেখানকার মানুষ আরও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে, এমন আশঙ্কা সবারই। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট । ডেল্টা টাইমস্/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |