এরদোয়ানের উত্থান কি মধ্যপ্রাচ্যে স্বস্তি আনবে
রায়হান আহমেদ তপাদার:
প্রকাশ: শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৫, ৩:৫১ পিএম

.

.

গত এক হাজার বছরের ইতিহাসে তুরস্কের রাজনীতিতে বড় ধরনের বাঁকবদলের ঘটনা রয়েছে। ১২৯৯ সালে অটোমান বা উসমানিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা তুরস্ককে ইতিহাসে নতুন এক জায়গা নির্ধারণ করে দেয়। ইতিহাস বলে, বিভিন্ন সময় অটোমানদের সঙ্গে ইউরোপের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল। অটোমানদের পতনের পর ১৯২৩ সালে ইউরোপের মিত্র কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে তুরস্ক নতুন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। প্রায় ১০০ বছর পর তুরস্ক আবার এক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে, যেখানে তুরস্কের নায়ক এরদোয়ান। এরদোয়ানের সঙ্গে ইউরোপের সরাসরি কোনো সংঘর্ষ না থাকলেও অটোমান-পরবর্তী শাসকদের মতো সম্পর্ক ততটা উষ্ণও নয়।


সিরিয়ায় আসাদ শাসনের পতন হয়েছে এবং ইরানের দীর্ঘদিনের শঙ্কা সত্য হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া জোটের অবসান ঘটেছে, যা তুরস্কের জন্য সুসংবাদ। আফ্রিকার হর্ন থেকে লেভান্ট ও আফগানিস্তান পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক মানচিত্র পুনর্গঠিত হতে পারে। এরদোয়ান সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছেন এবং তুরস্ক এখন আঞ্চলিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।


এ বাস্তবতার প্রভাব অঞ্চলটির সমস্ত প্রধান শক্তিকে প্রভাবিত করবে। তুরস্ক বিদ্রোহীদের গোয়েন্দা তথ্য, দিকনির্দেশনা ও রাজনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করেছে। সিরিয়ার সংঘাতের শুরুর বছরগুলোতে অনেক দেশ বিরোধী গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন দিয়েছিল, কিন্তু তুরস্ক সীমান্তের কাছে উত্তর-পশ্চিমের বিদ্রোহী এলাকা থেকে তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করেনি। ২০১৯ সালের পর অস্ত্রবিরতি কার্যকর হলে তুরস্ক বিদ্রোহীদের পুনর্গঠন ও অস্ত্র সংগ্রহ নিশ্চিত করেছে।


ইসরায়েলি হামলার ফলে হিজবুল্লাহ এবং লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই অঞ্চলে ইরান তার সমর্থিত শক্তিকে জনবল ও সম্পদ সরবরাহে অক্ষম। রাশিয়া যুদ্ধে ব্যস্ত ইউক্রেনে, ফলে আসাদ সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল। তুরস্কের সফলতা প্রতিবেশী ইরাকেও প্রভাব ফেলবে। তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে ইরাকের উত্তরে কুর্দিদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে এবং পিকেকে লক্ষ্যবস্তু করেছে।


সিরিয়ায় সুন্নি নেতৃত্বাধীন সরকারের উত্থান ইরাকের সুন্নিপ্রধান এলাকায় তুরস্কের প্রভাব আরও শক্তিশালী করবে। ২০১৯ সালে ইসলামিক স্টেটের পতনের পর এই এলাকাগুলো ইরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তুরস্কের উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র সিরিয়া ও ইরাকেই সীমাবদ্ধ নয়; আঙ্কারার বাসনা আফ্রিকা, ককেশাস এবং মধ্য এশিয়াতে বিস্তৃত। সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের বিজয়ের পর এরদোয়ান সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ার মধ্যে ভূখণ্ডগত বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত করতে সফল মধ্যস্থতা করেছেন। তুরস্ক লিবিয়াতেও গভীরভাবে যুক্ত। জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকারের সামরিক সমর্থন দিয়ে তুরস্ক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রভাব নিশ্চিত করেছে, যার মাধ্যমে তুরস্ক উত্তর আফ্রিকার জ্বালানি ও শক্তি উৎপাদনের প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আফগানিস্তানেও তুরস্কের প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়েছে। ২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর তাদের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালে আজারবাইজানকে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে তুরস্ক ককেশাস অঞ্চলে ইরানের উত্তরের সীমান্তের কাছে তার উপস্থিতি জোরদার করেছে। তুরস্কের এই উত্থান আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে জটিল করে তুলেছে, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং তার মিত্রদের জন্য।


সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে, এবং তুরস্কের উত্থান তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এরদোয়ানের ইসলামপন্থী নীতি সুন্নি মুসলিম ও রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে, যার ফলে সৌদি আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজতন্ত্রের একটি বিকল্প পন্থা তৈরির হুমকি অনুভব করছে। ইরান নির্ভর করেছে প্রক্সি শক্তির ওপর, কিন্তু তুরস্ক স্থানীয় সুন্নি শক্তিগুলোকে সরাসরি সমর্থন দিয়েছে।


২০১১ সালের আরব বসন্তের মতো জনপ্রিয় আন্দোলন গুলোয় জড়িয়ে তুরস্ক ওই অঞ্চলের জনগণের সমর্থন পেয়েছে, আর সৌদি আরবের আঞ্চলিক নেতৃত্বের দাবি দুর্বল হয়েছে। ২০১২ সালে মিসরে তুরস্ক-সমর্থিত ইসলামপন্থী সরকারের উত্থানের স্মৃতি উপসাগরীয় দেশগুলোয় আবার ফিরে এসেছে। ইরান ২০১৯ সাল নাগাদ চারটি আরব রাজধানী বাগদাদ, দামেস্ক, বৈরুত ও সানা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছিল, তবে এই সম্প্রসারণ কৌশল ইরান বেশি বাড়িয়ে ফেলেছিল, যার ফলে এখন তুরস্ক ও ইসরায়েলের মতো আক্রমণাত্মক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছে।


বিদ্রোহীদের বিজয় এবং তুরস্কের উত্থানের ফলে ইরান যে সহযোগিতা সরবরাহ করত হিজবুল্লাহ এবং হামাসকে, তা ব্যাহত হয়েছে। লেবাননেও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ইরানের পতনে তুরস্কের লাভ হয়েছে। সিরিয়া প্রায় পাঁচ দশকের ইরানি মিত্রতা থেকে বেরিয়ে এসে তুরস্কের বন্ধু হতে যাচ্ছে। তবে, তুরস্কের উত্থান শুধু ইরানের পতনের ফল নয়; এর পেছনে দেশটির সাহসী পররাষ্ট্রনীতি এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে মৌলিকভাবে ভিন্ন কৌশল রয়েছে।


তুরস্ক সামরিক হস্তক্ষেপ, কূটনৈতিক যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগের সমন্বয়ে সফলতা পেয়েছে, যা তাকে এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে। পশ্চিমাদের মধ্যে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ তার ইসলামপন্থী সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন, আবার কেউ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।


সামনের দিনগুলোয় এ অঞ্চলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর ইরানকে ঘিরে আবর্তিত হবে না। সেই জায়গা নেবে তুরস্ক। তুরস্ক এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করবে, কিন্তু প্রশ্ন হলো কীভাবে করবে? একসময়ের তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার এরদোয়ান বা তাঁর দলের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তাও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে একই আচরণ করছেন। রাজনীতির নাটকের চরিত্র বদল হয়েছে, কিন্তু আচরণে পরিবর্তন আসেনি।


তুরস্কে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও বাস্তবতা হলো, এরদোয়ান এখন নতুন সুলতান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। সব ক্ষমতাই এখন নিজের হাতে নিচ্ছেন। ইরান, চীন, এবং অন্যান্য দেশগুলোতে একই ধরনের কৌশল চলছে। পশ্চিমাদের এই ভ্রান্ত নীতি গণতন্ত্রের সঠিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করছে, যা বিশ্বজুড়ে সংঘর্ষ ও ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।



লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।

ডেল্টা টাইমস/রায়হান আহমেদ তপাদার/সিআর

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com