নো কফি, নো লাভ?
রহমান মৃধা:
|
![]() নো কফি, নো লাভ? কফি শুধু একটি পানীয় নয়; এটি সামাজিক সম্পর্ক, রোমান্স এবং আড্ডার কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন সংস্কৃতি ও অঞ্চলে কফির গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নিচে এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করে একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো। কফি ও সুইডিশ ফিকা: একে ছাড়া ভাবা যায় না! সুইডেনে ‘ফিকা’ বলতে বোঝায় বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সঙ্গে কফি ও পেস্ট্রি নিয়ে আরামদায়ক সময় কাটানো। ফিকা শুধু কফি পান নয়; এটি সামাজিক বন্ধনের এক অনন্য প্রতীক। সাম্প্রতিক সময়ে চা বা অন্যান্য পানীয় ফিকার অংশ হয়ে উঠলেও কফি ছাড়া কি ফিকার আসল উষ্ণতা বজায় থাকে? সুইডিশ সংস্কৃতিতে এ প্রশ্নটি এখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কফি হাউস: আড্ডার ঐতিহ্য— ইউরোপের কফি হাউসগুলো ইতিহাসে বৈপ্লবিক চিন্তা, সাহিত্য আড্ডা ও রোমান্টিক সংযোগের কেন্দ্রে ছিল। বিশেষ করে ভিয়েনা ও প্যারিসের কফি হাউসগুলো সামাজিক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। আজকের দিনে কফিশপগুলোর মাধ্যমে সেই সংস্কৃতি গ্লোবাল ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। তবুও কফিশপগুলো এখনো সামাজিক ও রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরির গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত। গণচীনে কফি: নতুন যুগের সূচনা— চীনের ঐতিহ্যবাহী চা–সংস্কৃতি সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কফি একটি স্ট্যাটাস সিম্বল এবং সামাজিক মিলনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। চীনে কফি এখন এক নতুন ‘কুল ফ্যাক্টর’। বিশ্বের বৃহৎ কফি চেইন ব্র্যান্ডগুলো সফলভাবে চীনের বাজারে প্রবেশ করেছে, যা চীনের আধুনিক সামাজিক ও রোমান্টিক সম্পর্কগুলোর একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং কফি উৎপাদনের সংকট— কফি উৎপাদনের প্রধান অঞ্চল, যেমন ব্রাজিল, ইথিওপিয়া ও ভিয়েতনাম, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উৎপাদন চাপে পড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৫০ শতাংশের বেশি কফি উৎপাদন এলাকা হুমকির মুখে পড়বে। বিজ্ঞানীরা বিকল্প প্রজাতির সন্ধানে কাজ করছেন, তবে কফির অভাব সামাজিক প্রভাব ফেলতে পারে। কফি কি খেতেই হবে? অনেকেই কফি না খেয়েও সামাজিক সংযোগ বজায় রাখেন। চা, হট চকোলেট বা অন্যান্য পানীয় কফির বিকল্প হতে পারে, তবে কফির মতো ‘সমাজতন্ত্র এবং রোমান্টিসিজমের মেলবন্ধন’ অন্য কোনো পানীয়ের মাধ্যমে সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কফি উৎপাদনে শীর্ষ দেশ ১. ব্রাজিল: বিশ্বের ৩৭ শতাংশ কফি উৎপাদন; ২. ভিয়েতনাম: রোবাস্টা কফির জন্য পরিচিত; ৩. কলম্বিয়া: উচ্চমানের আরবিকা কফি উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয়; ৪. ইথিওপিয়া: কফির জন্মভূমি; ৫. ইন্দোনেশিয়া ও হন্ডুরাস: উল্লেখযোগ্য উৎপাদক। বাংলাদেশ: কফি উৎপাদনের সম্ভাবনা বাংলাদেশের চিরাচরিত চা উৎপাদনের বাইরে পাহাড়ি অঞ্চলে কফি চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সম্ভাব্য অঞ্চল: ১. পার্বত্য চট্টগ্রাম: রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি; ২. সিলেট ও মৌলভীবাজার: আরবিকা কফি চাষের সম্ভাবনা; ৩. শ্রীমঙ্গল: প্রাথমিক পরীক্ষামূলক চাষ ইতিবাচক ফল দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ১. আবহাওয়া: পাহাড়ি এলাকার শীতল ও আর্দ্র পরিবেশ কফি চাষের জন্য অনুকূল। ২. মাটি: কফি চাষের উপযুক্ত পিএইচ (৬.০-৬.৫) বিদ্যমান। ৩. অর্থনীতি: আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যের কফি উৎপাদন লাভজনক হতে পারে। ৪. চাষাবাদ পরিস্থিতি: BARI পরীক্ষামূলক চাষে ইতিবাচক ফল পেয়েছে। চ্যালেঞ্জ: • জলবায়ুর অস্থিতিশীলতা। • গবেষণার অভাব। • প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। • বাজারের অপ্রতুলতা। ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি ১. আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ: উচ্চমানের আরবিকা কফি রপ্তানি। ২. অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো: তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কফির চাহিদা বাড়ছে। ৩. টেকসই কৌশল: দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনের জন্য পরিবেশবান্ধব–পদ্ধতি। কফি শুধু একটি পানীয় নয়; এটি মানুষের সামাজিক ও রোমান্টিক সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভবিষ্যতে কফি উৎপাদন কমে গেলেও এর সামাজিক প্রভাব ও জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকবে। গবেষণা, প্রযুক্তি ও নীতিসহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ কফি উৎপাদনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। সুপারিশ: ১. স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা বৃদ্ধি; ২. কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা। ৩. অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার তৈরিতে উদ্যোগ। ‘এক কাপ কফি’ মানুষের জীবনে ছোট একটি আনন্দের প্রতীক হলেও এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। এটি আমাদের সামাজিক ও রোমান্টিক জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে থাকবে। কফি শুধু একটি সাধারণ পানীয় নয়, এটি একটি অনুভূতি, একটি অভ্যাস এবং জীবনের রোমান্টিক মুহূর্তের অপরিহার্য সঙ্গী। কফি আজ বৈচিত্র্যে পূর্ণ— কফি লাতে, এক্সপ্রেসো, ব্ল্যাক কফি, কফি উইথ ক্রিম, কফি উইথ হট মিল্ক—আরও কত কী! প্রতিটি ধরনেই রয়েছে ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন অভিজ্ঞতা। এক কাপ কফি প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অনুভূতি যেন জীবনের ছোট্ট একটি রোমান্টিক মুহূর্তকে চিরস্থায়ী করে রাখে। কফির প্রতিটি চুমুকেই লুকিয়ে থাকে সম্পর্কের উষ্ণতা, প্রেমের গভীরতা এবং বন্ধুত্বের আন্তরিকতা। সুইডিশ সংস্কৃতিতেও কফি রোমান্টিকতার প্রতীক। একটি জনপ্রিয় সুইডিশ প্রবাদ বাক্য আছে, যা গানের ছন্দে বলা হয়: “Kaffe utan grädde Är som kärlek utan kyssar Och kärlek utan kyssar Är väl ingen kärlek, säg?” বাংলা অনুবাদ: ‘ক্রিম ছাড়া কফি যেন চুম্বন ছাড়া ভালোবাসা। আর চুম্বন ছাড়া ভালোবাসা, তা কি সত্যিই ভালোবাসা?’ এই প্রবাদটি কফির প্রতি ভালোবাসাকে ভালোবাসার অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করে। সুইডিশ মানুষের কাছে কফি শুধু পানীয় নয়, এটি সম্পর্কের উষ্ণতা ও রোমান্টিকতার এক মিষ্টি প্রকাশ—বাংলাদেশে! লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ডেল্টা টাইমস্/রহমান মৃধা/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |