আত্মহত্যা মানসিক রোগ, নাকি সামাজিক দায়
সাদিয়া সুলতানা রিমি:
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১০:৫১ এএম আপডেট: ০৪.০২.২০২৫ ১০:৫৬ এএম

আত্মহত্যা মানসিক রোগ, নাকি সামাজিক দায়

আত্মহত্যা মানসিক রোগ, নাকি সামাজিক দায়

আত্মহত্যা একটি জটিল ও বহুস্তরীয় সমস্যা, যা মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক প্রভাব এবং ব্যক্তিগত সংকটের সংমিশ্রণ। এটি শুধুমাত্র মানসিক রোগ বা শুধুমাত্র সামাজিক দায় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না; বরং উভয় কারণই এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেউ ঘরে কিংবা হাসপাতালে রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে বাঁচার জন্য আপ্রাণ প্রার্থনা করে যাচ্ছে, আবার কেউ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। দুটিই কষ্টের, তবে প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। কারো কষ্টটা শারীরিক আর কারো মানসিক। শারীরিক কষ্টের কাছে কখনো কখনো আমরা হেরে যাই এটা প্রাকৃতিক, কিন্তু মানসিক সমস্যার কারণ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক। তবে এই সমস্যা হাজারো জীবন সংহার করছে সারা দুনিয়ায়।

সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন এক হাজার ৯০০-র বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। আর এর মধ্যে দেড় হাজার অভাগা কিংবা অভাগীরই বাস নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশ এই তালিকায় অন্যতম দেশ, যে কি না স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় ওঠার অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশেও আত্মহত্যা নামক সামাজিক রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা একটি বড় সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘স্বাস্থ্য’ সংজ্ঞার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এটি কমার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী ২০০০ সালে বাংলাদশে প্রতি লাখে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ছিল গড়ে ছয়জন। এরপর ২০১৫ সালে দেখা যায়, প্রতি লাখে গড় হার ৩.৪ জন। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, ২০১৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতার আবার ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যায়। ২০১৯ সালে গড় হার ছিল ৩.৭ জন।

মহামারি ও সমসাময়িক সংকট তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। গত বছর জার্নাল অব অ্যাফেক্টিভ ডিস-অর্ডার রিপোর্টার্সের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের জরিপে ১৫১ জন ছাত্র-ছাত্রীর আত্মহত্যার তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে স্কুলের শিক্ষার্থী ৬৩ জন, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের ৪২ জন, কলেজের ২৬ জন এবং মাদরাসার ১৯ জন। ‘আঁচল’ নামে আরেকটি সামাজিক সংস্থার জরিপ বলছে, ২০২২ সালে জানুয়ারি থেকে আগস্টে সারা দেশে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ের আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে আরো গবেষণা হওয়া দরকার এবং এ নিয়ে সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি গভীরভাবে ভাবা দরকার। যুদ্ধ আর মন্দাজনিত বিশ্বসংকট, দেশে রাজনৈতিক সংকট এগুলোও ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে প্রভাব ফেলে আত্মহত্যার মতো সামাজিক রোগ বাড়িয়ে দিতে পারে।

‘আত্মহত্যা’ বিষয়টির সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে সংবেদনশীলতা নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, মানসিক সমস্যা জয় করতে পারলে আত্মহত্যায় জীবননাশের ঝুঁকিও জয় করা সম্ভব। যাঁরা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক সক্রিয় ও সার্বক্ষণিক সহায়তা খুবই জরুরি। যাঁরা মানসিক সমস্যায় আছেন, যাঁরা ভাবছেন এই সমাজ কী বলবে? তাঁদের বলছি, একবার ভেবে দেখুন এই সমাজ আপনাকে খাওয়ায় না পরায় যে সমাজের কথা ভেবে নিজেকে শেষ করে দেবেন। আর মা-বাবা? তাঁদের সঙ্গে শুধু ভালোভাবে কথা বলুন। বিশ্বাস করুন, আর কিচ্ছু চাই না তাঁদের। আর আপনি যার জন্য মারা যেতে চাচ্ছেন, শুধু ভাবুন, তার মতো বা তার চেয়ে খারাপ বা তার চেয়ে ভালো মানুষ এ দুনিয়ায় অঢেল নয় কি? শুধু একটু মানিয়ে নেওয়ার মনোভাব। ব্যস, আপনি আপাতদৃষ্টিতে সফল। এই সফলতাই পরবর্তী সময়ে স্থায়ী রূপ ধারণ করবে। আর ক্যারিয়ার? বিসিএসই কি ক্যারিয়ারের মাপকাঠি? একবার ভাবুন তো বিসিএসে মোট কয়টা আসন? বিসিএস ছাড়া সমাজে সবাই কি মরে গিয়েছে? কিছু একটা দিয়ে শুরু করুন। তারপর বিভিন্ন ট্রেনিং করুন। তারপর বুঝেশুনে চাকরি পরিবর্তন করুন। জীবন অনেক মূল্যবান। অন্যের জন্য নিজেকে কেন শেষ করবেন? ক্ষমা করতে শিখুন, উদার হোন; আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যকে সাহায্য করুন। মাঝেমধ্যে নদীর ধারে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করুন।
বিশিষ্টজনরা ‘আত্মহত্যা’ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেন, সেমিনার করেন, মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেন, তার পরও বরং আত্মহত্যা না কমে, দিন দিন আরো বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে শিক্ষিতজন ও শিক্ষার্থীরা যখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তখন তার কারণ গভীরভাবে অনুসন্ধান করাটা অতি জরুরি হয়ে পড়ে। আজকের শিক্ষার্থীরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তারাই চালাবে দেশ, এগিয়ে নেবে সমাজ। তাদের সুস্বাস্থ্যের মতোই সুস্থ-সাবলীল মনও জরুরি। অসুস্থ হলে আমরা যেমন ডাক্তারের কাছে যাই, ঠিক তেমনি মন খারাপ হলে মনোবিজ্ঞানীর কাছেও যাওয়া উচিত। এই প্র্যাকটিস অনেক জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তখন মনে হয়, এই দায় সমাজের আর সমাজবিজ্ঞানীদেরও বটে।

আমাদের সক্রিয় জীবনযাপন, আমাদের চিন্তা, আবেগ আর আচরণগুলো স্বাস্থ্যকরভাবে পরিচালনার জন্য সুস্থ মন জরুরি। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য এ দেশে উপেক্ষিত। মন খারাপের অনেক কারণ থাকতে পারে। সেগুলো অতিক্রম করার জন্য মনকে তৈরি করতে হবে। মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে আমরা পরিবার আর বন্ধুদের মতোই মনো-পরামর্শকের সাহায্য চাইতে পারি; কিন্তু শিক্ষার্থীরা সমস্যা শেয়ার করে না, মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে চায় না। শুধু কি লজ্জার জন্যই তারা মনোবিজ্ঞানীর কাছে যায় না? কখন যাওয়া উচিত তাও বুঝে উঠতে পারে না। এ ছাড়া মনোবিজ্ঞানী এ দেশে অতটা সহজলভ্যও নয়। আগে থেকে সিরিয়াল দিতে হয়। তারপর পরিদর্শন মূল্য অনেক বেশি আবার একবার গেলে কয়েকবার পরিদর্শনের কথা বলা হয়, আবার প্রতিবার মূল্য দিতে হয়। যে দেশে শারীরিক অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো বিলাসিতাই মনে করে সবাই।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের ১৮ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসচেতনতা এবং বিশেষ মুহূর্তে তাদের চাহিদা ও প্রবণতার প্রতি বেখেয়াল থাকার কারণে কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত শতকরা ১৮ ভাগ শিশু-কিশোরের কর্মদক্ষতা (পাঠ্যাভাসে অমনোযাগী) কমে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা প্রতিরোধে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, সৃজনশীলতা এবং পাঠ্যদক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রেখে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া বিশেষ জরুরি বলে বিবেচ্য।পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় মানুষের জাগতিক চিন্তা-চেতনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। মানুষের ভাবনার সময় সীমা কমে আসছে। স্বল্প সময়ের সিদ্ধান্তে অনেকে সফল হচ্ছে আবার অনেকে বিপথে চলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবের প্রতি কিশোর-তরুণদের আসক্তি এই প্রজন্মের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা, অবাস্তব কল্পনা, হতাশা ও আত্মহত্যা প্রবণতা যথেচ্ছভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া কিছু গেম (যেমন ব্লু হোয়েল) এবং অ্যাপসে কিশোর-কিশোরীদের সরাসরি আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করতেও দেখা গেছে। প্রযুক্তির আগ্রাসন নিরসনে তাদের সাবধান করা হলেও মনস্তাত্ত্বিক কু-প্ররোচনায় প্রাণ দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অনেকে আত্মহত্যার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও দিয়ে থাকে, ‘হয়তো এটাই আমার শেষ পোস্ট।’ আত্মহত্যার আগে অনেকে লাইভেও আসে। আর এ ধরনের বিষয়গুলো কিছু অসামাজিক চলচ্চিত্র, শর্টফিল্ম শিক্ষার্থীদের মানসিকতাকে দুর্বল করে তুলেছে। এসব সমাজবিরোধী ভিডিও ইন্টারনেটে তাদের সামনে আসছে যার শেষ পরিণতি তুচ্ছ বিষয়েও শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণীদের নির্মমভাবে আত্মহত্যা। 

কিশোর-তরুণ, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা হ্রাসকরণে ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা প্রয়োজন।শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়টি কয়েকটি কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে। এই আত্মহত্যাকে সামগ্রিকভাবে প্রতিরোধে পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষার উপস্থিতি, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ়করণ, সামাজিক সম্প্রীতি ও মেলবন্ধনের ক্ষেত্রগুলো সম্প্রসারিত করতে হবে। এই বিষয়গুলোর অভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে একরৈখিক, আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতার জন্য হচ্ছে তা থেকেই অপরাধ প্রবণতা, মাদকাসক্তি এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এসব বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা কারিকুলাম প্রণেতাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে শিক্ষার্থীদের অভিমত নেওয়াও আবশ্যক যে, তারা কোনো ধরনের পাঠ্যসূচিতে আরামপ্রদ অনুভব করবে। বিষয়টি হয়তো একটু জটিলতর হতে পারে, তবে প্রযুক্তির আগ্রাসন থেকে মুক্তির জন্য, পাঠ্যক্রমে একঘেয়েমি দূরীকরণে, পরীক্ষাভীতি রোধে সূদরপ্রসারী কার্যক্রম হাতে নেওয়া সময়োপযোগী। রস-কষহীন, আনন্দ-বিনোদনহীন সিলেবাস, একটানা ক্লাস, প্রাইভেট-কোচিংয়ের চাপ, বইয়ের বোঝা, শিক্ষকদের অসহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, সর্বত্র প্রতিযোগিতার কারণে শিক্ষার্থীরা যেন আজ যন্ত্রমানব! আর যান্ত্রিক জীবন পরিহারে আত্মহত্যা তাদের হাতছানি দিচ্ছে। কোনো পাঠ্যসূচিতেও তারা পড়তে পারছে না যে আত্মহত্যা মহাপাপ। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবোদয় হওয়া প্রয়োজন।আমাদের সমাজব্যবস্থায় রীতিমতো ভাঙন ধরেছে। একক পরিবারের আধিক্য, পারিবারিক বন্ধনের ঘাটতি ইত্যাদি কারণে শিশুরা প্রয়োজনীয় পারিবারিক শিক্ষা থেকে বি ত। চাকরিজীবী মা-বাবা অফিসে যাচ্ছেন, ছেলেমেয়েরা কাজের মানুষের কাছে লালিত-পালিত হচ্ছে। মা-বাবার কাছে থেকে জাগতিক বিষয়ে শেখার তেমন সুযোগ করে উঠতে পারছে না শিশুরা। মা-বাবাকে তাদের মনের ভেতর জমানো অভিব্যক্তিগুলো প্রকাশ করতে পারছে না। মনের চাপা কষ্ট থেকে তারা নিজের জীবনকে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধও করছে না। সন্তানদের আত্মহত্যার পরও মা-বাবার বোধোদয় হচ্ছে না। এমন দৃষ্টান্ত আজকাল সর্বত্র পরিলক্ষিত। 

তাই শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, সন্তানদের মানসিক চাহিদার দিকে নজর দেওয়া, শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। আজকাল অনেক মা-বাবা (স্বামী-স্ত্রী) স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সামনে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি করে থাকে। এতে সন্তানদের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ে তা ভেবে দেখেন কয়জন মা-বাবা? গ্রামা লে এই প্রবণতা বেশি এবং প্রায়ই পত্রপত্রিকায় উঠে আসে, ‘মা’কে মারা সহ্য করতে না পেরে সন্তানের আত্মহত্যা, ‘বাবার ওপর অভিমান করে সন্তানের বিষপান’ প্রভৃতি।আমরা জানি, সব ধর্ম বিশ্বাসেই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে এর ভয়াবহতা, শাস্তিও উল্লেখ করা আছে। কিন্তু এই বিশ্বাসবোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগ্রতকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ব্যর্থ, তা ঘনঘন আত্মহত্যার হৃদয় বিদারক ঘটনা থেকে নির্ণয় করা সম্ভব। ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের অনৈতিক স্বার্থের চর্চা, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসচর্চা, শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলে এনে দলবাজি করানো, ক্ষমতার অপপ্রভাব প্রভৃতি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মন্দ প্রভাব সৃষ্টি করছে। এ কথা স্বীকার্য, শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া, মাদকাসক্ত হওয়া, বইবিমুখী হওয়া ও আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ধর্মীয় উগ্রপন্থিতা, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণসহ সব সমাজব্যবস্থা দায়ী। আর সমাজ থেকে এসব দূরীকরণে উদ্যোগ নেওয়া না হলে কখনোই আত্মহত্যার মতো সামাজিক ব্যাধিকে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। একই পথে পা বাড়াবে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী প্রজন্ম তথা সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীরা। বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যাও বেশ উদ্বেগজনক। বোঝা যাচ্ছে, সমাজব্যবস্থার অবক্ষয়ের কারণে আত্মহত্যা ক্রমেই বৈশিক ব্যাধিতে ধাবিত হচ্ছে।

গণমাধ্যমের তথ্য, সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার আত্মহত্যার সমস্যা মোকাবিলায় নতুন মন্ত্রণালয় গঠন করেছেন। শুধু তাই নয়, আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে কাউন্সিলিংয়ের পদক্ষেপ নিয়েছেন। উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে একেক দেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা একেক রকম হওয়ায় দেশে দেশে তরুণ ও শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণও ভিন্ন হতে পারে। আর তাহলো সমাজব্যবস্থার আশু সংস্কার করার উদ্যোগ হাতে নেওয়া। কথা হলো, কে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে? সমাজপ্রতিরা আত্মহত্যাপ্রবণ নয় বলে সাধারণ জনগণের সমস্যা নিরসনে তার তৎপর নয়। আর শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গ নিয়ে ভাববার কোনো সময় নেই তাদের। কিংবা এই নিয়ে গবেষণাকারী ও সংস্থাকেও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করা হয় না। সরকারপ্রধানরা অসাধু শিক্ষক ও মন্ত্রীদের হাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ন্যস্ত করে দিয়েই চিন্তামুক্ত। আর শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের না পড়িয়ে শ্রেণিকক্ষে টেবিলের ওপর পা তুলে ঘুমাচ্ছে। ছাত্ররা পরীক্ষার মতো কঠিন বাধা পার হতে নিরুপায় হয়ে অনৈতিক পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষকরা তাদের সংশোধনের পথ না দেখিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করছে। বহিষ্কার পত্রে লিখে দিচ্ছে, ‘তোদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই’। ধিক্কার জানাই শিক্ষকদের এমন নোংরা মানসিকতাকে। আজ যদি তারা ন্যায়-নিষ্ঠাবান হতেন, পাঠদানকে মহৎ কাজ মনে করতেন, শিক্ষকরা পেশাদারিত্ব সম্পূর্ণ থাকতেন, তাহলে একটি শিক্ষার্থীও বিপদগ্রামী হতো না, আত্মহত্যার পথ বেছে নিত না। তাই আমি মনে করি, শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য, শিক্ষাবাণিজ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসার উদ্যোগ এবং কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করতে হবে।

আত্মহত্যা কোনো গন্তব্য নয়; বরং নিজেকে জানা, বোঝা এবং ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে এখানে লাগাতার উন্নতি সম্ভব।আত্মহত্যাকে শুধুমাত্র মানসিক রোগ কিংবা শুধুমাত্র সামাজিক দায় হিসেবে দেখা ঠিক নয়। এটি একটি বহুমুখী সমস্যা, যার সমাধানে পরিবার, সমাজ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা, সহমর্মিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং সংকটে থাকা ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানো আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।


লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

ডেল্টা টাইমস/সাদিয়া সুলতানা রিমি/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com