জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ও প্রজন্মের ভাবনা
তানবীর নাঈম:
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:২৫ পিএম

জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ও প্রজন্মের ভাবনা

জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ও প্রজন্মের ভাবনা

জ্ঞানের চর্চা, সংরক্ষণ ও মানবজাতির কল্যানে জ্ঞান বিতরণের জন্য কালের প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে গ্রন্থাগার। আজ আমরা যে আধুনিক গ্রন্থাগার দেখি তার ইতিহাস দুই হাজার বছরের বেশি। তবে এর আগে ৪০০০-৫০০০ বছর পূর্বেও গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব ছিলো বলে ধারণা করেন গবেষকরা। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি আধুনিক লাইব্রেরির অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বর্তমান আধুনিক বিশ্বের গ্রন্থাগারের সাথে তুলনায় বাংলাদেশে গ্রন্থাগারগুলো সেই অর্থে আধুনিক বলা যায় না। বিশ্বজুড়ে লাইব্রেরির ধারণাই আজ পরিবর্তন হয়ে গেছে। লাইব্রেরী হয়ে উঠেছে একাধারে জ্ঞানবিতরণ কেন্দ্র, সামাজিক মিলনমেলার স্থান,  একই সাথে বিনোদন কেন্দ্রও বলা যায়। একসময় গ্রন্থাগার ছিলো আবদ্ধ, সাধারণ মানুষের জন্য তা উন্মুক্ত ছিলো না। গনতন্ত্রের প্রসারে জ্ঞানবিজ্ঞানে জনসাধারণের প্রবেশের পাশাপাশি ঐ সকল রাজরাজড়াদের লাইব্রেরিও উন্মুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য।

আজ ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। এবার “সমৃদ্ধ হোক গ্রন্থাগার এই আমাদের অঙ্গীকার” স্লোগানে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ২০২৫ পালন করা হচ্ছে । ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর মন্ত্রীপরিষদের এক সভায় ৫ ফেব্রুয়ারী জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিনটিকে স্বরণে রাখতে এই দিনটিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে এই দিনটি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন হয়ে আসছে। সর্বস্তরের মানুষকে গ্রন্থাগারমুখী করে তোলার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে দিবসটি পালন করা হয়। কোন দিবস পালন করার উদ্দেশ্য থাকে ওই বিষয় সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা। র‍্যালি, সভা-সমাবেশ, আলোচনা, মতবিনিময়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, বই পাঠ প্রতিযোগিতা, পাঠ্য সামগ্রী বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি নিয়ে এই দিনটি পালিত হয়ে থাকে। জ্ঞানার্জন, চেতনা, মূল্যবোধের বিকাশ, গবেষণা, সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে গ্রন্থাগারের অপরিসীম ভুমিকা রাখার প্রত্যাশায় গ্রন্থাগার দিবসের প্রবর্তন।

স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গবেষক, সাধারণ মানুষ সবার জ্ঞানের পিপাসা মেটানোর জন্য গ্রন্থাগার সেবা প্রদান করে যায়। রাষ্ট্রের উন্নয়নে গ্রন্থাগারের ভুমিকা অনুমান করার জন্য তথ্যবিহীন একটা রাষ্ট্র কল্পনা করা যায়, যেখানে কোন তথ্য লিপিবদ্ধ নেই, না আছে পূর্বের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কোন নথিপত্র। এমন একটা রাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে যদি টিকে থাকা সম্ভব না হয় তাহলে লাইব্রেরির উন্নয়ন ছাড়াও কেন রাষ্ট্রের উন্নয়ন হতে পারে না এই ধারণাটুকু আমরা পেতে পারি। গ্রন্থাগার শুধু বই ধারণ করে এমন নয়, একটা জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, অর্জন, আবিষ্কার সবই ধারণ করে। পূর্বের সাথে বর্তমানের সেতুবন্ধন তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রন্থাগারের গুরুত্ব আলোচনায় বলেছেন "এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়িয়া আছে। বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেধে দেয়া সাঁকো"। গ্রন্থাগার আমাদের বইয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায় এবং জ্ঞানের সাগরে প্রবেশ করার রাস্তা বাতলে দেয়।

বর্তমান বিশ্বে যে রাষ্ট্র যতবেশি তথ্যসমৃদ্ধ সে রাষ্ট্র ততবেশি উন্নয়নের পথে অগ্রসর। শুধু তথ্যের উৎপাদন আর মজুত থাকলেই এই উন্নয়ন সম্ভব নয় কখনোই। এর জন্য দরকার তথ্য খুজে বের করা এবং যথাযথ ব্যবহার করতে জানা জনশক্তি। রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই কাজে দক্ষ করে তুলতে ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে গ্রন্থাগার কাজ করে। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস একটি প্রতীকী দিবস মাত্র। এই দিবস শুধুমাত্র একটি দিনে পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই দিনকে সামনে রেখে পরবর্তী এক বছরের কর্মপরিকল্পনা সাজানো উচিত। নতুন গ্রন্থাগার স্থাপন, নতুন পাঠক তৈরী, নতুন লেখক তৈরী, গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের পেশাগত উন্নয়ন, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক গ্রন্থাগার উন্নয়ন সহ আলোকিত জাতি গঠনে সব ধরনের পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা উচিৎ।
গ্রন্থাগারের উন্নয়নে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেওয়া ও গ্রন্থাগার পেশাজীবিদের উপযুক্ত মূল্যায়ন করা সরকারের কর্তব্য। আমাদের সমাজে গ্রন্থাগার বলতে এখানো সেই আলমারিতে সাজানো সারি সারি বইয়ের চিত্রই মানসপটে ভেসে উঠে। কিন্তু প্রযুক্তির ছোয়ায় গ্রন্থাগারের ধারনা পরিবর্তিত হয়ে ডিজিটাল গ্রন্থাগার হয়ে গিয়েছে বেশ আগেই। গ্রন্থাগারে ডিজিটাল তথ্যসামগ্রী সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আছে ই-বুক, পিডিএফ, সিডি, ডিভিডি, ইন্টারনেট পরিসেবা, অনলাইন গবেষণা জার্নাল, অনলাইন ডকুমেন্টেশনসহ প্রয়োজনী সবধরনের সেবা। পাঠক চাইলে খুব সহজে ঘরে বসেই গ্রন্থাগারের সকল ডিজিটাইজড ভার্সন একসেস পেয়ে ঘরে বসেই পড়াশোনা করতে পারছে। সময়, শ্রম, অর্থ সাশ্রয়ী এই পদ্ধতি প্রয়োগে দরকার ডিজিটাল অবকাঠামো ও দক্ষ জনশক্তি। পর্যাপ্ত অর্থ বিনিয়োগে সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি নিয়োগের মাধ্যমে গ্রন্থাগারগুলো ডিজিটাল গ্রন্থাগারে পরিণত করতে পারে। শুধু সারি সারি বইয়ের ধারণা থেকে বের হয়ে গ্রন্থাগারকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপন কর যেতে পারে।

গ্রন্থাগার দিবসের আবেদন হলো গ্রন্থাগারের বার্তা সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া। সুযোগসুবিধা সম্পন্ন শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রন্থারের সেবা পৌছে দেয়া। তথ্যসমৃদ্ধ জনগণ রাষ্ট্রের জন্য সম্পদ তাই তথ্য পৌছে দিতে গ্রন্থাগারকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আলোকিত ও সত্যিকার শিক্ষিত সচেতন দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কাজ করছে। “সমৃদ্ধ হোক গ্রন্থাগার এই আমাদের অঙ্গীকার”স্লোগানে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালন সফল হোক। আধুনিক তথ্যনির্ভর জাতি গঠনে প্রযুক্তির ছোয়ায় পাঠাগার সেবা সকলের কাছে পৌছে যাক।


লেখক : শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


ডেল্টা টাইমস/তানবীর নাঈম/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com