ট্রাম্প-মোদি সংলাপ : ভিন্ন মেরুর অভিন্ন ছায়া
খন্দকার আপন হোসাইন:
প্রকাশ: বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১০:২৮ এএম

ট্রাম্প-মোদি সংলাপ : ভিন্ন মেরুর অভিন্ন ছায়া

ট্রাম্প-মোদি সংলাপ : ভিন্ন মেরুর অভিন্ন ছায়া

ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নরেন্দ্র মোদি—দুই নেতার উত্থান দুটি ভিন্ন মেরু থেকে শুরু। কৌশল ও অবস্থানের দিক থেকে তারা অদ্ভুত এক অভিন্নতায় আবদ্ধ। একদিকে ট্রাম্প রাজনীতির নিয়ম ভেঙে ধ্বংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক রূপে নিজেকে প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে মোদি কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী আদর্শের মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছেন। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক কেবল বন্ধুত্বের গল্প নয়। দুই শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের মিলনবিন্দু থেকে বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন অধ্যায় সূচিত হতে যাচ্ছে।

মার্কিন রাজনীতির মঞ্চে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন ছিল বিস্ময়কর। ভারতীয় উপমহাদেশিক রাজনীতির মঞ্চে মোদির রাজনৈতিক যাত্রাও ছিল চমকপ্রদ। ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে যায়। এরপর ট্রাম্প-মোদি সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়েছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর আবার উষ্ণ হতে যাচ্ছে তাদের সম্পর্ক। ট্রাম্পের বিজয়ে মোদির মুখে ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার’ স্লোগানে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে উপমহাদেশের রাজনীতি। কিন্তু এই সম্পর্ক কি আগের মতো উষ্ণ থাকবে নাকি ভিন্ন কোনো মোড়ে ঘুরে দাঁড়াবে—সেটাই এখন প্রশ্ন।

দুই নেতার রাজনৈতিক দর্শনেও অনেক মিল। জনসমক্ষে চটকদার বক্তব্য, আবেগমথিত প্রচারণা এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রকাশে উভয়েই সফল। নিজেদের একান্ত ভক্তগোষ্ঠীকে সঙ্গে রাখার ক্ষেত্রেও পরিপূর্ণ সফল। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানের মতোই মোদির ‘নতুন ভারত’ নির্মাণের স্বপ্ন একধরনের রাজনৈতিক কৌশল। এই কৌশল জনমানসে সহজেই প্রভাব বিস্তার করে।

ট্রাম্পের শাসনামলে কড়া অভিবাসন নীতি সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতো। মোদির শাসনামলেও অভ্যন্তরীণ বিভাজন, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) এবং কাশ্মীর বিতর্ক বারবার তাকে আলোচনার কেন্দ্রস্থলে মধ্যমনি করে রেখেছে। এ যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ট্রাম্প প্রশাসন যখন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলে ‘বহিরাগত’ ঠেকাতে ব্যস্ত মোদি ভক্তদের একাংশও তখন মুসলিমদের বহিরাগত প্রমাণে ব্যস্ত থেকেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তাদের রাজনৈতিক সমীকরণ অলিখিত চুক্তিতে বাঁধা।

ট্রাম্প-মোদি বৈশিষ্ট্যে সহস্র সাদৃশ্য থাকলেও বৈপরীত্যও কম নয়। নরেন্দ্র মোদি ৫০ বছরের রাজনীতির অভিজ্ঞতায় ধীরে ধীরে নিজেকে পরিণত করেছেন। অপরদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফল ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিকে রূপান্তর রাজনীতির আকাশে উত্থিত উল্কা। মোদি গৃহীত  সিদ্ধান্তসমূহ যথেষ্ট পরিকল্পিত কিন্তু ট্রাম্প ততটা বিচক্ষণ নয়। কোন কারণ ছাড়াই আকস্মিক টুইটে ট্রাম্প যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। ট্রাম্প রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে নতুন এক নিয়মহীন পৃথিবী তৈরি করতে চান। পক্ষান্তরে প্রতিটি পদক্ষেপ ধীর, সুনির্দিষ্ট এবং বিপরীতমুখী।

সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের পাশাপাশি উভয়ের মধ্যে অদৃশ্য লড়াইও রয়েছে। ট্রাম্প ভারতকে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে দেখে বলেই জানি। কিন্তু ‘ফার্স্ট আমেরিকা’ নীতির ছায়া ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপরই পড়ে। আবার মোদি কখনোই তার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ অন্য কারও হাতে ছাড়বে না বা ছাড়তে ইচ্ছুকও হবে না। তার এই অবস্থান ট্রাম্পের একচ্ছত্র নেতৃত্বের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে বাধ্য। সে হিসেবে ট্রাম্প-মোদি সম্পর্ক হলো অনিশ্চিত পথের যাত্রী। সামনের বছরগুলো ভারত-মার্কিন সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প তার নিজস্ব নিয়মে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাবেন। এতে হয়তো অনেক সময় দিল্লি অস্বস্তিতে পড়বে। ট্রাম্পের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকান স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া।  অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিল্লির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মোদির কৌশলগত ধৈর্য এবং ট্রাম্পের অস্থির মনোভাবই নির্ধারণ করবে সম্পর্কটি কোন দিকে যাবে। কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে ট্রাম্পকে বোঝাতে সক্ষম হলে ভারত তাদের জন্য অপরিহার্য অংশীদার হবে এবং সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। অন্যদিকে ট্রাম্পের ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার নতুন সংকটও ডেকে আনতে পারে।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বর্তমানে এক বিশেষ পরিসরে রয়েছে। বহু বৈশ্বিক ইস্যু, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য সম্পর্ক এবং পরমাণু শক্তির প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলমান। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-এ ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশেষ এক বৈঠক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একত্রিত হচ্ছেন। বৈঠকটি দেশ দুটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বাইরে বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির জন্যও অতি গুরুত্বপূর্ণ। মোদী ও ট্রাম্পের বৈঠকটি ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত হবে। আলোচিত এ বৈঠকে একাধিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং নিরাপত্তা নীতিমালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রথম আলোচ্য বিষয় হবে ভারতের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নয়ন। বর্তমানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ১৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। দুই দেশই এই সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করতে আগ্রহী। ভারতের উন্নয়নশীল বাজারের সুযোগকে কাজে লাগাতে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতের পণ্যগুলো মার্কিন বাজারে প্রবেশে কোনো বাধা না রেখে এবং মার্কিন প্রযুক্তি, গার্মেন্টস, এবং কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের জন্য এক নতুন বাণিজ্যিক অ্যারেঞ্জমেন্টের প্রস্তাব দিতে পারে। ফলে ভারতের ট্যারিফ এবং বাণিজ্যিক বাধাগুলো শিথিল করা হবে।

দ্বিতীয়ত ট্রাম্প-মোদি বৈঠকে আলোচনা হতে পারে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র ক্রেতা দেশগুলো মার্কিন সুরক্ষা সরঞ্জামের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা সরঞ্জাম, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, এবং প্রশিক্ষণ ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও বাড়তে পারে। ভারতের বিশেষ নজর রয়েছে ভারত মহাসাগরের অঞ্চলে, যা দক্ষিণ এশিয়ার সামুদ্রিক নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় অভিবাসীদের বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। বর্তমান মার্কিন প্রশাসন ভারতের অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। এই বিষয়ে ভারতে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। মোদী প্রশাসন অবশ্যই অভিবাসী সমস্যা সমাধানে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করবে। প্রযুক্তিগত খাতে কাজ করা ভারতীয় পেশাজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বা ভিসা প্রদান নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ইস্যুগুলো নিয়ে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও চীনের ভূমিকা নিয়ে। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। ট্রাম্প প্রশাসনও চীনের আগ্রাসী নীতির সমালোচনা করেছে। ভারতকে সমর্থন দেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতে পারে। বিশেষ করে সাগর ও হিমালয় অঞ্চলে চীনের সামরিক উপস্থিতি মোকাবিলার জন্য।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এ বৈঠক দক্ষিণ এশিয়া ও পুরো ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতির উপর বিশাল প্রভাব ফেলবে। বিশ্বব্যাপী চীন ও পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক মনোভাবও এই বৈঠকের ফলস্বরূপ পুনরায় রূপ নিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে গুরুত্ব দিয়ে, এই বৈঠক চীন ও পাকিস্তানের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোভাবের ভারসাম্য ঘটানোর একটি পদক্ষেপ হতে পারে। একটি মূল বিষয় হবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে পাকিস্তান-চীন সম্পর্কের উপর চাপ সৃষ্টি করা। 

সময়ই বলে দিবে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে ট্রাম্প-মোদি সম্পর্ক কেমন রূপ নিবে। তাদের সম্পর্ক কি আবার নতুন করে উষ্ণ হবে? নাকি আরও জটিলতায় মোড় নেবে? সেটাই দেখার বিষয়। এক নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক। এখন অপেক্ষা শুধু সময়ের পরবর্তী পালাবদলের। ট্রাম্প-মোদি বৈঠকটি বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের এই জোরদারিতায় বিশ্বব্যাপী চীনা প্রভাবের গুরুত্ব কমবে। আসন্ন ট্রম্প-মোদি বৈঠকটি কেবল সংলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এতে দুটি জাতির সমুদ্রসম তীব্রতা ও শঙ্খধ্বনি অবস্থিত। এই বৈঠকের ঢেউ কতটুকু শান্ত হবে বা কতটুকু তীব্রতার শোরগোল তুলবে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে।

লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও সংগঠক।

ডেল্টা টাইমস্/খন্দকার আপন হোসাইন/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com