দুর্নীতি প্রতিরোধই হোক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
প্রজ্ঞা দাস:
|
![]() দুর্নীতি প্রতিরোধই হোক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ২০২৪ সালে, আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা কোনো সাধারণ সংখ্যা নয়; এটি একটি সতর্কবার্তা, একটি করুণ দলিল। বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৫১তম স্থানে, যা বিগত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবনমন। সিপিআই ২০২৪ অনুযায়ী বাংলাদেশের ২৩ পয়েন্টের দুর্নীতির স্কোর প্রমাণ করে, রাষ্ট্রব্যবস্থা কোনো এক অনির্দেশ্য অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য সেবা, এমনকি নিম্নস্তরের প্রশাসনেও দুর্নীতির ছোবল লক্ষ্য করা যায়। ঠিকাদারি কাজে টেন্ডার বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতে অনিয়মিত নিয়োগ, ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ—এসব কিছুই দুর্নীতির নিত্যদিনের চিত্র। দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২-৩ বিলিয়ন ডলার দুর্নীতির মাধ্যমে হারিয়ে যায়। এই অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হতো, তাহলে দেশের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সম্ভব হতো। দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে না, বরং সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি, সুশাসনের অভাব এবং সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির কারণে সরকারি সেবা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে ন্যায্যতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। দুর্নীতি কখনো একা আসে না। এর সঙ্গে আসে ক্ষমতার লোভ, স্বার্থের হিসাব আর জনগণের নীরবতা। দুর্বল প্রতিষ্ঠান, জবাবদিহিতার অভাব, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই দুর্নীতির পিছনে লুকায়িত প্রধান কারণ। এছাড়াও, নৈতিকতার অবক্ষয়, সামাজিক সচেতনতার অভাব এবং দুর্নীতিকে সহজভাবে গ্রহণ করার মানসিকতাও আমাদের সমাজে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। দুর্নীতির ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়, যা সামাজিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে। সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়, যেখানে সুবিধাবঞ্চিতরা আরও নিপীড়িত হয়, আর ক্ষমতাবানরা আরও শক্তিশালী হয়। অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দেয়। বিনিয়োগ কমে যায়, উন্নয়ন ধীর হয়ে যায়, কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়। প্রশাসনিক জটিলতা প্রবল আকার ধারণ করে, যেখানে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না, ফলে সাধারণ নাগরিকদের ন্যায্য অধিকারও পণ্যে পরিণত হয়। দুর্নীতির কারণে সরকারি প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় এবং সম্পদের অপচয় ঘটে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি হুমকির মুখে পড়ে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে দেখে এবং বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়, যা কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমন অবস্থা অর্থনীতির জন্য ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। দুর্নীতি সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। তাই দুর্নীতির মতো এমন সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। দুর্নীতির মতো এত বড় সামাজিক ব্যাধিকে একদিনে নিরাময় সম্ভব নয়, তবে আজকের পদক্ষেপ আগামী দিনে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতির দিকে ধাবিত করবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রথমেই প্রয়োজন শক্তিশালী ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এছাড়াও, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে না। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বিধান করতে হবে। সরকারি কার্যক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে। ডিজিটালাইজেশন ও ই-গভর্নেন্সের মাধ্যমে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব। অনলাইনে সেবা প্রদান, ই-টেন্ডারিং এবং ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা যায়। শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা ও সুশাসন সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশে কোনো রকম রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বাধা না থাকে। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই পথে হাঁটতে সাহস না পায়। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে, নাগরিকদেরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সুশীল সমাজ এবং তরুণ প্রজন্মকে এ সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা, এবং সর্বোপরি জনগণের সম্মিলিত জাগরণ। আমাদের দেশ, আমাদের ভবিষ্যৎ—এই দুটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি দুর্নীতিকে রুখতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যৎ ধূসর হয়ে যাবে। কিন্তু যদি একবার শেকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের স্বপ্নের দেশ, যেখানে ন্যায় থাকবে, সুশাসন থাকবে, উন্নয়ন থাকবে। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধের বিকল্প নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই হোক আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকার। শুধু আইন ও নীতিমালা নয়, আমাদের মানসিকতা ও চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এটি শুধু একটি লক্ষ্য নয়, আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ। ডেল্টা টাইমস/প্রজ্ঞা দাস/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |