বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
প্রজ্ঞা দাস:
|
![]() বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো শিল্প খাত, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই খাত এক অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশ, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেমে এসেছে ৩.৫ শতাংশ। যা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। শিল্প খাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, কাঁচামালের আমদানি জটিলতা, এবং উচ্চ উৎপাদন খরচ বিনিয়োগকারীদের জন্য এক বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগের বিষয়ে দ্বিধান্বিত, এবং বহির্বিশ্বের বিনিয়োগকারীরাও বিকল্প বাজারের দিকে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৫.২২ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ গত কয়েক বছর ধরে সরকার ৭ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করে আসছিল। এই প্রবৃদ্ধির পতন প্রমাণ করে যে দেশের উৎপাদনশীলতা, বিনিয়োগ ও রপ্তানি খাত মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পরেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি ১০ শতাংশ কমে গেছে, যা পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশ্বব্যাংকের “Poverty and Shared Prosperity” রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা চরম সংকটে পতিত হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাথাপিছু আয় এর নিম্নগামীতা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৫ সালে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ নতুনভাবে দারিদ্র্যের আওতায় আসতে পারে। সংখ্যাটা বাংলাদেশের মতো দারিদ্র এবং বেকারত্বের সমস্যায় জর্জরিত একটি দেশের কাছে অত্যন্ত সংকার বিষয়। বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ পতন ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থনৈতিক সংকটের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়। খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য টিকে থাকার সংগ্রাম কঠিন করে তুলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে সরকারকে দ্রুত কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে দেশ ভয়াবহ সংকট এবং ভারসাম্যহীনতার দিকে ধাবিত হবে। শিল্প খাত পুনরুজ্জীবনে এবং স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়া। শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলতে হবে। শিল্প খাতে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তরুণ প্রজন্মের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এতে নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তাধারা সামনে আসবে শিল্প খাতে প্রয়োগ করে দেশের উন্নয়ন সাধিত হবে। পাশাপাশি ব্যাপক পরিসরে শিল্প খাতের উন্নয়ন এবং শিল্প খাতের পরিধি বৃদ্ধি পেলে কর্মসংস্থান বাড়বে বেকারত্ব এবং দারিদ্রতা কমবে। যা দেশের জন্য এক বিরাট আশার দার উন্মোচন করবে। বর্তমান সময়ের পরিপেক্ষিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং বাজার কারসাজি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। দুর্নীতির কালো হাত ভেঙ্গে দেওয়া। পাশাপাশি কেউ যাতে দেশীয় অর্থ বিদেশে পাচার করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে সহজ বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে রপ্তানি বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। এই অবস্থায় রপ্তানি শক্তি হয়ে উঠতে পারে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যকরণ এবং মান উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তৈরি পোশাক তো বাংলাদেশের একটি বিরাট রপ্তানি খাত। পাশাপাশি প্রযুক্তি, কৃষিপণ্য, ঔষধ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং প্রকৌশল খাতে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সরকারের সাহায্য পূর্ণ হস্তক্ষেপ জরুরী। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদার নিশ্চিতের জন্য এবং দেশের সামগ্রী অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে রয়েছে দারিদ্রতা এবং বেকারত্ব থেকে মুক্তি। তাই জনগণকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্বের হ্রাস ঘটাতে হবে। দক্ষতা উন্নয়ন এবং নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক নীতি গ্রহণ বর্তমান সময়ে অত্যন্ত জরুরী। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সময়োচিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে, সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হয়ে উঠবে। সংকট মোকাবিলায় সুপরিকল্পিত নীতি ও বাস্তবমুখী উদ্যোগই পারে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সেই লক্ষ্যে সরকার, সরকারি ও বেসরকারি সকল স্তরের সকল কর্মকর্তা কর্মচারী, সাধারণ জনগণ এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সাহসী উদ্যোগ, সম্মিলিতভাবে কর্মতৎপরতা এবং প্রত্যেকটি সেক্টরের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার নিশ্চিত করোনই পারে অর্থনীতির এই সংকটাপূর্ণ সময় কাটিয়ে তুলে অর্থনীতি স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে, যা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রে পরিণত করবে। লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ। ডেল্টা টাইমস/প্রজ্ঞা দাস/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |