শৌর্য-বীর্যের প্রতীক সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে
মো. জিল্লুর রহমান:
প্রকাশ: শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১০:১৬ এএম

শৌর্য-বীর্যের প্রতীক সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে

শৌর্য-বীর্যের প্রতীক সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালন করা হয়। মূলত ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশের উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে সুন্দরবন রক্ষায় জনসচেতনতার লক্ষ্যে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়।

সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এটি। জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অন্যতম এক আকর্ষণীয় স্থান। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রিয় আবাসভূমি এটি। ঘুর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফনী ও বুলবুলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবেলা করে সগৌরবে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন, যা দেশে বিদেশে বাংলাদেশ অহঙ্কার।

বলা হয় বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এর আক্রমনে মানুষের মতো সুন্দরবনও মরিয়া হয়ে বুক পেতে প্রমান করেছে, সেই আমাদের বিপদের সবচেয়ে বড় বিশ্বস্ত বন্ধু। সুন্দরবন এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঢালস্বরূপ বর্মন হিসাবে কাজ করেছে। সুন্দরবন আমাদের বিপদের বিশ্বস্ত বন্ধু এটা বিভিন্ন সময় প্রমাণিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এর আক্রমনে উপকূলে সম্পদের অনেক ক্ষতি হলেও প্রাণহানির পরিমাণ ছিল খুবই নগন্য এবং তখন এটা ছিল খুবই স্বস্তিদায়ক ঘটনা।

শুধু ঘূর্ণিঝড় আম্পান' এর ক্ষেত্রেই ঘটেনি। এর আগে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বরে বুলবুল, ২০০৯ সালের ২৫ মের ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় সিডর মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আছড়ে পড়লেও সুন্দরবনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল; প্রাণহানিও হয়েছিল আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেয়ালের মতো কাজ করে সুন্দরবন। 

এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত। সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত, যার প্রায় ৬৯ শতাংশ স্থলভাগ ও ৩১ শতাংশ জলভাগ।৫০টির অধিক প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। এ বনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এ ছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, আট প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণি। সুন্দরবনে বসবাসকারী প্রায় ৩২০ প্রজাতির পাখির অধিকাংশই স্থানীয় বা আবাসিক। ২০০৪ সালের হিসেব মতে, সুন্দরবন প্রায় ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঘের আবাসস্থল ছিল কিন্তু সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ, এক থেকে দেড় লাখ চিত্রা হরিণ, ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার বানর এবং ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার বন্য শূকর রয়েছে। 

সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ৭৮৯তম বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। তিনটি বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত এ বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকার মোট আয়তন এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এ বন দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। সুন্দরবন বায়ুমন্ডলের কার্বন ধরে রেখে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমিত করে ও পরিবেশ সংরক্ষণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। সুন্দরবন মাছ, জ্বালানি, মধু ও অন্যান্য অপ্রধান বনজদ্রব্যের উৎস। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে অতুলনীয় এবং ভ্রমণ পিপাসুদের প্রশান্তি, বিনোদন ও আনন্দের উৎস।

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণের কারণে এখানে পর্যটন শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। প্রতি বছর বহু দেশি-বিদেশি পর্যটক, গবেষক, ছাত্র-শিক্ষক সুন্দরবন ভ্রমণ করে। সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য রয়েছে সাতটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্পট। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে সুন্দরবনে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেছে। এরমধ্যে প্রায় দুই হাজার ৫০০ জন বিদেশি পর্যটকও ছিল।

ঝড়-ঝঞ্জা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষের আগ্রাসন থেকে বার বার বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় লাখ লাখ মানুষ ও সম্পদকে মায়ের আঁচলের মতো রক্ষা করে চলেছে সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ক্ষত কাটতে না কাটতেই ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানে। এবারও উপকূলীয় এলাকার মানুষকে বুক পেতে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তবে এ জন্য সুন্দরবনকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবনে কোনো বন্যপ্রাণির প্রাণহানি না ঘটলেও অবকাঠামো ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার তুলনায় অনেক কম। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বুলবুলের তান্ডবে পাঁচ হাজার ১৭৬টি গাছ উপড়ে ও ভেঙে গেছে। এর মধ্যে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগে চার হাজার ৫৮৯টি গাছ ও পূর্ব বন বিভাগে ৫৮৭টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে যেমন, ঠিক তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এই বন কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়াও কাঠ, জ্বালানী ও মন্ডের মত প্রথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের এই ভূমি একই সাথে প্রয়োজনীয় আবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি সম্পদের আধার এবং পর্যটন কেন্দ্র।

এই বন প্রচুর প্রতিরোধমূলক ও উৎপাদনমূলক ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ১৯৯৫ সালের এক তথ্যমতে, বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫১ শতাংশ জুড়ে সুন্দরবনের, বন থেকে আসা মোট আয়ে অবদান প্রায় ৪১ শতাংশ এবং কাঠ ও জ্বালানী উৎপাদনে অবদান প্রায় ৪৫ শতাংশ। অনেকগুলি শিল্প যেমনঃ নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা, আসবাবপত্র ইত্যাদি সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন অ-কাঠজাত সম্পদ এবং বনায়ণ কমপক্ষে আধা মিলিয়ন উপকূলবর্তী জনসংখ্যার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। উৎপাদনমূখী ভূমিকার পাশাপাশি সুন্দরবন, ঘূর্ণিঝড় প্রবণ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনসংখ্যা ও তাদের সম্পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসেবে ভূমিকা রাখে।

অথচ এ বনের অস্তিত্ব ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। এ বন নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা বলছেন জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার অন্যতম শক্তি সুন্দরবন। অথচ তেলের ট্যাংক ডুবে বনের অভ্যন্তরের পানি পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষিত হওয়া, ঘনঘন মনুষ্য সৃষ্ট আগুন, নির্বিচারে কাঠ কেটে বন উজাড় করা, বিষাক্ত ওষুধ দিয়ে জেলেদের মৎস্য ও জলজ প্রাণিসম্পদ ধ্বংস করা, চোরা শিকারি ও বনসংলগ্ন এলাকায় শিল্প-কারখানা নির্মাণের কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলছে। আর এ বনের পাশে নির্মিতব্য রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া সুন্দরবন। এভাবে চলতে থাকলে একমাত্র প্রাকৃতিক বর্মন সুন্দরবন হারিয়ে যেতে বেশি দিন সময় লাগবে না। এজন্য সকলকে সচেতন হওয়া জরুরি। আসুন আমরা শৌর্য-বীর্যের প্রতীক সুন্দরবনকে বাঁচাতে সচেতন হই, নিজে বাঁচি, সুন্দরবন বাঁচাই এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে সে আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবে রক্ষা করবে।


লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

ডেল্টা টাইমস্/মো. জিল্লুর রহমান/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com