মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সুস্থ জীবনের অপরিহার্য অংশ
ফাতেমাতুজ জোহুরা:
|
![]() মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সুস্থ জীবনের অপরিহার্য অংশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, "স্বাস্থ্য মানে কেবল শারীরিকভাবে অসুখমুক্ত থাকা নয়, বরং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা একসঙ্গে অর্জিত হলেই তা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য।" কিন্তু আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা এতটাই কম যে, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ বা শুচিবায়ুতে (OCD) আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের সমস্যাগুলোকে গোপন করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০২৩ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ১৭% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এই রোগীদের মধ্যে ৮০% কখনো চিকিৎসকের কাছে যান না। আরেকটি উদ্বেগজনক তথ্য হলো, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে— ১.বিষণ্ণতা (ডিপ্রেশন) ২.পারিবারিক ও সামাজিক চাপ ৩.চাকরির অনিশ্চয়তা ৪.সম্পর্কের টানাপোড়েন ৫.পড়াশোনার চাপ। বিশেষ করে, কিশোর-কিশোরী এবং তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ ও হতাশা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৫-২৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ৪০% মানসিক চাপের শিকার। এদের মধ্যে অনেকেই সামাজিক ও পারিবারিক সমর্থন না পাওয়ায় সমস্যাগুলো চেপে রাখে এবং শেষ পর্যন্ত হতাশায় ডুবে যায়। কেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা জরুরি? আমাদের সমাজে এখনও প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, যা মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা স্বীকার করতে বাধা দেয়। যেমন— * "মানসিক রোগ মানেই পাগল হওয়া" → সত্য হলো, মানসিক সমস্যা অনেক ধরনের হতে পারে, যার বেশিরভাগই চিকিৎসাযোগ্য। * "কষ্ট চেপে রাখা ভালো" → মানসিক কষ্ট চেপে রাখলে তা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। * "বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ দুর্বলতা" → এটি কোনো দুর্বলতা নয়, বরং একটি মানসিক অবস্থা, যা চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমরা প্রায়ই শুনি, ‘মানুষকে তার কাজ দিয়ে বিচার করা হয়, মন দিয়ে নয়।’ কিন্তু কাজের পেছনে যে সুস্থ মন দরকার, তা নিয়ে খুব কম মানুষই চিন্তা করে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে একজন ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন, এমনকি পেশাগত জীবনেও সফল হতে পারেন। আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণার কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে মানুষ চুপ থাকে— ১. বিষণ্ণতা, উদ্বেগ বা শুচিবায়ু থাকা মানেই মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়া নয়। এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য অবস্থা। ২. অনেকেই মনে করেন, মানসিক কষ্ট কাউকে জানানো দুর্বলতা। কিন্তু এটি কোনো দুর্বলতা নয়, বরং সহায়তা চাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ৩. "পরিবার ও সমাজে মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়" – এই ধারণার ফলে অনেকেই সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারেন না, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। ৪. সোশ্যাল মিডিয়া ও মানসিক স্বাস্থ্য বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক—এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নেতিবাচক প্রভাব: অন্যের সাথে তুলনা: সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের সুখের মুহূর্ত দেখে অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন। সাইবার বুলিং: অনলাইনে কটূক্তি বা নেতিবাচক মন্তব্য মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। অতিরিক্ত সময় ব্যয়: দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ইতিবাচক প্রভাব: সচেতনতামূলক পোস্ট দেখে অনেকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে পারেন। মানসিক সমর্থন পাওয়ার জন্য বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপ ও কমিউনিটি রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা চেনার উপায় অনেকেই বুঝতে পারেন না যে, তারা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। যদি নিচের লক্ষণগুলো বারবার দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে এটি একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা হতে পারে— * সারাক্ষণ ক্লান্তি অনুভব করা * ছোটখাটো বিষয়ে প্রচণ্ড উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা করা * আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া * ঘুমের সমস্যা * আত্মহানির চিন্তা করা যদি এসব লক্ষণ কারও মধ্যে দেখা যায়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত পেশাদার মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আমরা কী করতে পারি? ১. পরিবার থেকে সচেতনতা শুরু করা: বাবা-মা ও অভিভাবকদের শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা উচিত। ২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা চালু করা: স্কুল-কলেজে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা থাকা জরুরি। ৩. কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা,অফিসে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কর্মশালা চালু করা যেতে পারে। ৪. সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিবাচক প্রচারণা চালানো: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি সুস্থ মনের জন্য কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন— ✔ প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন ✔ পর্যাপ্ত ঘুম নিন (৭-৮ ঘণ্টা) ✔ ধ্যান ও মেডিটেশন করতে পারেন ✔ আপনার অনুভূতিগুলো বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে ভাগ করুন ✔ পেশাদার কাউন্সেলিং নিন (যদি প্রয়োজন হয় ✔ পর্যাপ্ত ঘুম নিন, কারণ কম ঘুম উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। ✔ নিয়মিত ব্যায়াম করুন, যা মস্তিষ্কে ভালো অনুভূতি সৃষ্টি করা হরমোন নিঃসরণ বাড়ায়। ✔ কাউকে বিশ্বাস করুন এবং মনের কথা বলুন, এতে চাপ কমে যায়। ✔ সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করবেন না, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটান। ✔ প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, এতে কোনো লজ্জার কিছু নেই। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চুপ থাকার সময় আর নেই। আমাদের সমাজে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে যেমন খোলামেলা আলোচনা হয়, তেমনি মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত।আপনি যদি কখনো হতাশ বোধ করেন, দয়া করে একা বসে থাকবেন না। কারও সঙ্গে কথা বলুন, সাহায্য নিন। মনে রাখবেন, মানসিক সুস্থতাই প্রকৃত সুখের চাবিকাঠি। লেখক : শিক্ষার্থী, কলেজ রোড, চকবাজার, চট্টগ্রাম। ডেল্টা টাইমস/ফাতেমাতুজ জোহুরা/সিআর/এমই
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |