চার লাখ টন খাদ্যের নীরব সমাধি
ড. এস. এম. শহীদুল্লাহ
|
![]() চার লাখ টন খাদ্যের নীরব সমাধি এদেশে বছরব্যাপী বিভিন্ন পরিবেশ ও মৌসুমে নানা প্রকারের ধান চাষ হয়ে থাকে। মোটাদাগে বলতে গেলে ৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে রোপা আমন, ৪৭ লাখ হেক্টরে বোরো, ৯ লাখ হেক্টরে আউশ এবং ৪ লাখ হেক্টরে জলি আমন ধানের আবাদ হয়। জলি আমন ধানের পুরো এলাকাই বপন পদ্ধতির আওতায় রয়েছে। তাছাড়া আউশ মৌসুমের ধান চাষেও প্রায় এক-চতুর্থাংশ জমিতে বপন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই দুইটি অঙ্ক বাদ দিলে বাকি প্রায় ১১০ লাখ হেক্টর জমিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে একমাত্র রোপণ পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়। সফলভাবে ধান উৎপাদনের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ লাখ গুচ্ছ প্রয়োজন হয়। বীজ কৃষির প্রথম এবং প্রধান ভিত্তি। ফসল উৎপাদনের অন্য সব কৃষি উপকরণের কমতি, ঘাটতি বা অনুপস্থিতিতেও ভিন্নমাত্রায় ফলন আসে। কিন্তু বীজ ব্যতীত কোনো ফলনই আশা করা যায় না। কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদনে বীজের স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ অন্যতম প্রধান শর্ত। আমাদের দেশের কৃষকরা প্রচলিত ধারায় ফসল উৎপাদন করে এবং এর সাথে উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা সুনিশ্চিত করে বীজ উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে আপামর কৃষক এখনও পূর্ণ সচেতন নন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিএডিসির ডিলার/বিশুদ্ধ কোম্পানি/ডিলার/নিকটাত্মীয়/বিশ্বস্ত বীজ উৎপাদনকারী থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজতলায় সঠিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে চারা উৎপাদন করলে একটি চারাই একটি গুচ্ছের জন্য যথেষ্ট হয়। সুতরাং এক হেক্টর জমি রোপণের জন্য ৩ লাখ চারা ব্যবহার করলেই চলে। সে হিসেবে ৩ লাখ বীজধান বীজতলায় বপন করতে হবে। বর্তমানে যেসব জাতের ধান চাষ করা হয় সেগুলিতে একটি বীজের ওজন সর্বোচ্চ ২৫ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। তাই উল্লেখিত প্রয়োজনীয় বীজের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭.৫ কেজি। মাঠ পর্যায়ে সাধারণভাবে ধারণা হিসেবে ২০% অতিরিক্ত বীজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এক হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করতে সর্বোচ্চ ৭.৫ × ১.২০ = ৯ (নয়) কেজি বীজ প্রয়োজন। সারা বাংলাদেশের চিত্র বিবেচনায় প্রতি হেক্টর জমিতে ধান রোপণের জন্য বীজতলায় যে পরিমাণ বীজ বপন করা হয় তার পরিমাণ গড়পড়তা ন্যূনতম ৫০ কেজি। প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা অত্যন্ত ক্ষীণ ও দুর্বল হয়। তাই প্রতি গুচ্ছে ৪-৭টি চারা রোপণ করা হয়। এতে করে প্রতি হেক্টরে ৪১ কেজি বীজ অতিরিক্ত ব্যবহার করে শুধুই অপচয় করা হচ্ছে। সারা দেশে ১১০ লাখ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করতে ৪.৫১ লাখ টন বীজধান অযথাই মাটির নিচে পুতে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশে চাল আমদানির পরিসংখ্যানে সর্বশেষ বার্ষিক আমদানির পরিমাণ ৩ লাখ টন। পক্ষান্তরে অপচয়কৃত বীজধান থেকে ঠিক ৩ লাখ টন চাল পাওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ অপচয় এবং আমদানির পরিমাণ একেবারেই সমান। এ অপচয় রোধ করতে পারলে দেশে আপাতত চাল আমদানি করা দরকার হবে না। প্রধান কারণ হলো, ধানের বীজ অত্যন্ত সহজলভ্য ও সস্তা বিধায় কৃষক ভাইয়েরা এটাকে কিছুই মনে করেন না এবং এটি যে অপচয় তা মেনে নিতেও নারাজ। এটি হচ্ছে সাধারণ চিত্র। উত্তর—হ্যাঁ, তবে এটি সহজ নয়। একজন কৃষকের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ চিন্তা করার দরকার নেই এবং তার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। এ ভাবনাটি জাতীয় পর্যায়ের। গবেষক, সম্প্রসারণ কর্মী এবং নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী থেকে সম্মিলিতভাবে এ প্রয়াস চালাতে হবে। এ প্রস্তাবনা শুধুই একটি কল্পনাবিলাসী গাণিতিক মডেল নয়। এটি যে বাস্তব এবং কৃষকগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন তা সহজেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যেতে পারে। কিছু কিছু হাইব্রিড ধানের বিভিন্ন জাতের চাষ হচ্ছে দেশের সর্বত্রই। উৎপাদনকারী কোম্পানি তাদের বীজ বিপণন করার স্বার্থে এ শ্লোগান স্বার্থকভাবে প্রয়োগ করেছে— “একটি মাত্র বীজ থেকে একটি সুস্থ সবল চারা, আর একটি মাত্র চারা থেকে একটি গুচ্ছ”। হাইব্রিড ধানের বীজ যেহেতু অনেক চড়া দামে বিক্রির টার্গেট নেওয়া হয়েছে, তাই চাষীগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আগেভাগেই তারা এ প্রযুক্তির সফলতা প্রমাণ করেছে। আর সুকৌশলে কৃষককে একটি অশুভ বার্তাও পৌঁছে দিয়েছে যে, এ প্রযুক্তি শুধুই হাইব্রিড ধানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দুঃখজনকভাবে এ বার্তাটিকে কৃষকসহ সর্বস্তরের সংশ্লিষ্ট মহল খুব ভালভাবেই গিলেছে। কোম্পানির পক্ষে স্লোগান দেওয়ার জন্য তো বুদ্ধিজীবীদের কোনো অভাব হয় না। দেশ ও জাতির পক্ষে এ বিষয়টি দেখার জন্য কি কেউ দাঁড়াবে? লেখক : সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার,রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ ব্রি, গাজীপুর ডেল্টা টাইমস/সিআর
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |