মনের প্রশান্তি ও চিন্তার প্রসারতায় প্রয়োজন আনন্দভ্রমণ
খন্দকার আপন হোসাইন:
|
![]() মনের প্রশান্তি ও চিন্তার প্রসারতায় প্রয়োজন আনন্দভ্রমণ দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে দেখা শুধু আনন্দের বিষয় নয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ারও একটি মাধ্যম। বাংলাদেশের মতো একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এক কথায় অতুলনীয়। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন, সাজেক ভ্যালির পাহাড়ি পথ, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক ইত্যাদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। এই আকর্ষণীয় স্থানগুলো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবন্ত সাক্ষী। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী 'সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন'। বাংলাদেশের সুন্দরবন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য সুন্দরবন বাঘ, হরিণ, কুমির এবং নানা প্রজাতির পাখির আবাসস্থল হিসেবেও বিখ্যাত। দেশের বাইরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আরও আলাদা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবনযাপন পদ্ধতি জানার সুযোগ মেলে। থাইল্যান্ডের বুদ্ধ মন্দির, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, মিশরের পিরামিড, ইতালির কলোসিয়াম, জাপানের ফুজি পর্বত এগুলো শুধু স্থাপত্য বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়। এগুলো মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাক্ষী। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১,১৫৪টি স্থান বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি স্থান থেকে কিছু শেখার আছে। ভ্রমণ মানুষকে করে তোলে উদার, সহনশীল। ভ্রমণের সময় নতুন নতুন মানুষদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি জানা যায়। ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের সঙ্গে মিশলে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। জীবনকে দেখা যায় নতুনভাবে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন “জীবন চলন্ত সাইকেল চালানোর মতো যেখানে ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে চলতেই হবে।” ভ্রমণও তেমনই জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখে। নতুন অভিজ্ঞতা দিয়ে মন ও মনন প্রাণবন্ত করে তোলে। ভ্রমণকে বলা হয় পর্যটন শিল্প। আজকের পর্যটন আসলে সেই প্রাচীন অভিযাত্রারই আধুনিক রূপ। কোনো এককালে মানুষ বেরিয়ে পড়ত নতুন শিকারের সন্ধানে। আজ বের হয় নতুন অভিজ্ঞতার তাড়নায়। কেউ পাহাড় ভালোবাসে, কেউ সমুদ্র, কেউ প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে দাঁড়িয়ে কল্পনায় হারিয়ে যেতে চায় হাজার বছর আগে। কেউ মাচু পিচুর ধাপে ধাপে হাঁটে, কেউ গিজার পিরামিড ছুঁয়ে দেখে, কেউ গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীর অতল স্পর্শ করতে চায়। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মিশেল দ্য মোঁতেন বলেছিলেন, "ভ্রমণ আমাদের মনের জড়তা দূর করে, দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে, আর নতুন নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয়"। বিশ্ব পর্যটন এখন অর্থনীতির বিশাল চালিকাশক্তি। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (ইউএনডব্লিউটিও) অনুযায়ী ২০১৯ সালে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ১০.৪%। কোভিড-১৯ মহামারির সময় এই শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটন ৭৪% কমে গিয়েছিল। বিমান চলাচল, হোটেল, পর্যটন সংস্থা সবই ক্ষতির মুখে পড়েছিল। তবে মানুষ থেমে থাকেনি। ২০২৪ সালে পর্যটন আবার প্রাক্-অতিমারি স্তরে পৌঁছেছে। ২০২৫ এ আরও ২% বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য বর্ণনাতীত। সেখানেও পর্যটন একটি প্রধান শিল্প। তাজমহল থেকে কাশ্মীরের গুলমার্গ, রাজস্থানের মরুভূমি থেকে আন্দামানের নীল জলরাশি সবই পর্যটকদের টানে। ২০১৯ সালে ভারত ছিল বিশ্ব পরিভ্রমণ সূচকে ২৯তম। ২০২৪ সালে এসে ১০ ধাপ নিচে নেমে ৩৯তম স্থানে পৌঁছেছে। কারণ হলো মুদ্রাস্ফীতি, পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা। অনেকে মনে করে বই পড়ে, ইউটিউব দেখে, ডকুমেন্টারি দেখে বিশ্ব চেনা যায়। তাদের ধারণা আসলে সঠিক নয়। ভ্রমণ সংকীর্ণ মনোভাব, কুসংস্কার আর গোঁড়ামিকে ধ্বংস করে। একটি দেশ, একটি জাতি বা একটি সংস্কৃতি বোঝার জন্য শুধু বই পড়া যথেষ্ট নয়। সেই দেশের রাস্তায় হাঁটতে হয়, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাদের রান্নার স্বাদ নিতে হয়। একটি মন্দির, একটি মসজিদ, একটি গির্জা বা একটি প্যাগোডার সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করতে হয় তার ইতিহাস। ভ্রমণ মানে শুধু ছবি তোলা নয়, নতুন মানুষ চেনা, নতুন গল্প সংগ্রহ করা। ভ্রমণ মানে পাহাড়ের গায়ে হাত রেখে কঠিন শিলার উষ্ণতা অনুভব করা। ভ্রমণ মানে নদীর পাড়ে বসে ঢেউয়ের ভাষা শোনা। ভ্রমণ মানে মরুভূমির রাতে মাথার ওপরে নক্ষত্রমণ্ডলী দেখে হারিয়ে যাওয়া অনন্ত মহাবিশ্বের ভাবনায়। কখনও কখনও ভ্রমণ পঞ্চম মাত্রায় পৌঁছে যায়। যেমন কাজাখস্তানের সবুজ প্রান্তরে ঘোড়া চরতে দেখে মনে হয় প্রথম মানুষ কেমন করে এই বিশাল তৃণভূমিতে জীবন শুরু করেছিল? ইরানের জাগ্রোস পর্বতের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মনে হয় কীভাবে প্রথম কৃষক বীজ বুনেছিল? পৃথিবী বিশাল। মানুষের কৌতূহল আরও বিশাল। নতুন জায়গা দেখার, নতুন গল্প শোনার, নতুন মানুষ চেনার আকাঙ্ক্ষা মানুষের রক্তে বইছে। কেউ হয়তো বলে "আমি একাই ঘুরব, একাই দেখব।" কিন্তু সত্য হলো ভ্রমণ কখনও একা হয় না। প্রকৃতি, মানুষ, ইতিহাস, সংস্কৃতি সবাই হাত ধরে নিয়ে চলে এক অনন্ত অভিযানে। ভ্রমণে বের হলে জীবনের ছোট ছোট সুখগুলো উপলব্ধি করা যায়। একটি নতুন রাস্তা, একটি অচেনা গলি, একটি অজানা ফুল এগুলো মনে জাগায় আনন্দ। ভ্রমণে দেখা যায়, জীবন কত সহজ, কত সুন্দর। ভ্রমণে নতুন কিছু জানার, শেখার আগ্রহ তৈরি হয়। ভ্রমণ মানুষকে করে তোলে সৃজনশীল। গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্রমণ মানুষের সৃজনশীলতা বাড়ায়। ২০১২ সালে কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ভ্রমণ করেন, তাদের সৃজনশীল চিন্তার ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশি। ভ্রমণ মানুষকে শেখায়, পৃথিবী কত বড় আর মানুষ কত ছোট। এই বোধ মানুষকে করে তোলে বিনয়ী। ভ্রমণ মানুষের মধ্যে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা তৈরি করে। অন্য দেশের বা অঞ্চলের জীবনধারা দেখলে তাদের কষ্ট ও সংগ্রাম উপলব্ধ হয়। নিজেদের সংকীর্ণতা দূর হয়। ২০১৬ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বহির্বিশ্বে ভ্রমণ করা শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি সামাজিক ও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। ভ্রমণ একধরনের চিকিৎসাও বটে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন ভ্রমণ মানসিক চাপ কমায়, উদ্বেগ কমায়, মন ভালো রাখে। ২০১৮ সালে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে নিয়মিত ভ্রমণ করলে হতাশা ও একঘেয়েমির হার কমে যায়। প্রতিটি ভ্রমণ একেকটি গল্প। পথে দেখা মানুষগুলো, অজানা শহরগুলো, নতুন সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা আমাদের ভেতরে এক অনন্য পরিবর্তন আনে। জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শেখায়। থেরু গোতমা বলেছিলেন “ভ্রমণ কখনো শেষ হয় না, এটি কেবল নতুন দিগন্তের সূচনা।” ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে গেলে চিন্তায় পরিবর্তন আসে। ফ্রান্সের সাঁ নদীর পাড়ে বসে মনে হয় সময় থমকে গেছে। মরক্কোর সাহারায় হাঁটলে বোঝা যায় নীরবতাও কথা বলে। পাহাড়ের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, মানুষ কত ক্ষুদ্র! হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা অভিযাত্রীরা বলেন, "শিখরে পৌঁছানোর পরও মনে হয়, আরো দূরে যেতে হবে।" এই অনুভূতি ভ্রমণ থেকেই আসে। প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ দেখে মনে হয় পৃথিবীর বিশালতা কত অনন্ত! ১৯৫৩ সালে প্রথম এভারেস্ট জয়ের পর এডমন্ড হিলারি বলেছিলেন, "আমরা পর্বত জয় করিনি, আমরা নিজেদের জয় করেছি।" ভ্রমণের শিক্ষা চিরস্থায়ী। ইতালির রোমে গেলে ইতিহাসের স্পর্শ পাওয়া যায়। মেসোপটেমিয়ার ধ্বংসাবশেষ মনে করিয়ে দেয় সভ্যতা চিরস্থায়ী নয়। ভ্রমণ শুধুই আনন্দ নয়, আত্ম-অনুসন্ধানের পথ। ভারতের গঙ্গার তীরে বসে কেউ ধর্ম খুঁজে পায়। গ্রিসের একফোরা দেখে কেউ দর্শনের অর্থ খোঁজে। পরিবেশ বদলালে মনও বদলায়। গবেষণা বলে, যারা বছরে অন্তত দু’বার ভ্রমণে যান, তাদের মানসিক চাপ কম থাকে। নেচার জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটালে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতা ৫০% বৃদ্ধি পায়। ভ্রমণ মানুষের হৃদয়কে প্রসারিত করে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা বাড়ায়। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবী এক ছায়ার মতো। এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেলে বোঝা যায় সংস্কৃতির ভিন্নতা কত সুন্দর। এক শৈলশিরায় দাঁড়িয়ে মনে হয় এই বিশাল সৃষ্টির মাঝে আমরা কত তুচ্ছ। ভ্রমণের কোনো শেষ নেই। পথে থাকলেই শেখা যায়। পথই গন্তব্য। লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও সংগঠক। ডেল্টা টাইমস্/খন্দকার আপন হোসাইন/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |