বেলফোর ঘোষণা যেভাবে মধ্য প্রাচ্যের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল
নাইমুর রহমান:
প্রকাশ: শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫, ১১:৫৭ এএম

বেলফোর ঘোষণা যেভাবে মধ্য প্রাচ্যের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল

বেলফোর ঘোষণা যেভাবে মধ্য প্রাচ্যের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল

এক টুকরো কাগজে লেখা ৬৭টি শব্দ বিশ্বে এমন এক কঠিন বৈরিতার জন্ম দিয়েছিল যা আজও মুসলিম বিশ্বের জন্য কান্নার কারণ। সময় গড়িয়েছে ঠিকই কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সেই সোনালী অতীত আর ফিরে আসেনি। স্বাধীনতা ধরা দিতে দিতেও যেন ধরা দেয়নি। হাসেনি গাজায় বসবাসরত সাধারণ মানুষ  বরং সময়ের সাথে সাথে তাদের কষ্ট দূর্দশা বহুগুনে বেড়েছে। হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেছে কেবল মাত্র একটি চিঠির জন্য। বরাবরই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু  সমাধান করা সম্ভব হয়নি ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে চলমান সংঘাতের মধ্যেই এই বেলফোর ঘোষণার ১০৮ বছর পূর্ণ হয়েছে।সাতষট্টি শব্দের এই নথি, ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসকে চিরতরে বদলে দেয়।এটি সেই সময়কার কথা যখন ফিলিস্তিন অঞ্চলটি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্থাৎ ওই ভূখণ্ডের প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের হাতে ছিল।ইসরায়েলিরা এই বেলফোর ঘোষণাকে আজকের আধুনিক ইসরায়েল গঠনের ভিত্তি বলে মনে করে।

অন্যদিকে আরব বিশ্বের একাংশ মনে করে এই নথির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। কেননা এই ফিলিস্তিন অঞ্চল একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।উসমানীয় শাসন (১৫১৬–১৯১৭) ফিলিস্তিন উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।  এরপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেট (১৯২০–১৯৪৮)প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে।  সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা PLO (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) আলজেরিয়ায় "ফিলিস্তিন রাষ্ট্র" ঘোষণা করে, যা ১৩৮টি UN সদস্য রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। তবে বাস্তবিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এখনও অর্জিত হয়নি। ব্রিটিশ সরকার যখন অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে তখন আরবরা ব্রিটিশদের সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল।তাই বেলফোর ঘোষণাকে তারা পিঠে ছুরিকাঘাতের মতো মনে করে।

বেলফোর ঘোষণার পর, ইহুদি অভিবাসীরা ফিলিস্তিন অঞ্চলে ভিড় করতে থাকে।তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এই ঘোষণাপত্রটি একটি সিল করা খামে ব্যারন লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন।ব্যারন লিওনেল তখন ব্রিটেনে বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন বড় নেতা ছিলেন। ওই চিঠিতে লেখা ছিল:

প্রিয় লর্ড রথসচাইল্ড

মহামান্য সরকারের পক্ষ থেকে, নিম্নলিখিত এই বিবৃতিটি আপনাকে পাঠাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। জায়নবাদী ইহুদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সমর্থন দেয়া এই বিবৃতিটি মন্ত্রিসভায় পেশ করা হয়েছে এবং মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদিত হয়েছে।

'মহামান্য ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে, তবে এটাও নিশ্চিত করা হচ্ছে যে, এমন কিছু করা উচিত হবে না যা ফিলিস্তিনে অবস্থানরত অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার কিংবা অন্য দেশে বসবাসকারী ইহুদিরা যে অধিকার এবং রাজনৈতিক মর্যাদা ভোগ করছে, তার কোন হানি হয়।'

আপনি যদি জায়নবাদী ফেডারেশনের কাছে এই ঘোষণা পৌঁছে দেন তাহলে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।

বেলফোর ঘোষণার নামকরণ করা হয়েছিল আর্থার জেমস বেলফোরের নামে। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার নেতৃস্থানীয় সদস্য, ধনাঢ্য এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী থেকে আসা আর্থার জেমস বেলফোর, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করার সাথে সাথে কনজারভেটিভ পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে পার্লামেন্টে যোগ দেন।স্কটিশ বংশোদ্ভূত, বেলফোর ১৯০২ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন

ওই চিঠিটি লেখার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল  ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন।  পরবর্তীতে এই  অঞ্চল থেকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনির বাস্তুচ্যুত হওয়ার পেছনে এই বেলফোর ঘোষণার  প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। ইসরায়েলিদের জন্য, বেলফোর ঘোষণাটি এমন একটি নথি ছিল যা ইসরায়েলিদের দাবি করা প্রাচীন ভূমিতে ওই জাতির বিকাশ লাভের স্বপ্নকে পূরণ করেছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য এই বেলফোর ঘোষণা এমন এক দুঃসময় ডেকে আনে যা আজও অব্যাহত রয়েছে।কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদি গণহত্যা বা হলোকাস্টের ভয়াবহতা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের চাপ বাড়তে থাকে।

 ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে মধ্যরাতে, ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের মেয়াদ শেষ হয় অর্থাৎ ওই অঞ্চলে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটে। ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই অঞ্চলটি ছেড়ে যায়। একই দিনে ইসরাইল তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে আর সেখান থেকেই ইতিহাসের পালাবদল শুরু।

ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্টার পর থেকে একে একে ফিলিস্তিনের ভূমিকে গ্রাস করেছে সাথে সাধারণ মানুষদের উপর চালিয়েছে অমানষিক নির্যাতন খুন গণহত্যা, ধর্ষণ। ইজরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পর মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননের সমন্বয়ে আরব লীগ ইজরায়েল আক্রমণ করে। 

কিন্তু পশ্চিমাদের সহায়তায় ইজরায়েল বিজয়ী হয় ফলে ফিলিস্তিনের বৃহৎ অংশ ইজরায়েলের দখলে যায়। লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুতে পরিণত হন  যাকে (النكبة, "নাক্ববা" বা বিপর্যয়) বলা হয়। ১৯৬৭ ইজরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা, সিনাই উপদ্বীপ, গোলান মালভূমি ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইজরায়েলি বসতি নির্মাণের সূত্রপাত।  ১৯৬৭-এ হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য মিশর ও সিরিয়া ইজরায়েলের উপর surprise attack চালায় ১৯৭৩ সালে।  এই যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে  আরব সাফল্য লাভ করলেও ইজরায়েল পাল্টা আক্রমণে সিনাই ও গোলান মালভূমি ধরে রাখে। যার ফলে ওই অঞ্চলে তেল উত্তলন থমকে যায় এবং তেল অবরোধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে শান্তিচুক্তি হলেও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র তা ভঙ্গ করেছে। গাজা উপত্যকায় মুহুর্মুহু আক্রমণ চালিয়েছে। 
   
গাজা সংঘাত  ২০০৮- বর্তমান পর্যন্ত চলমান    

২০২১ সালে পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ও আল-আকসায় সহিংসতার প্রেক্ষাপটে হামাসের রকেট ও ইজরায়েলের বিমান হামলা।২০০৭ সাল থেকে   গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণে আসে  ফলে পরবর্তীতে ইজরায়েল এবং হামাসের মধ্যে সংঘাত চলতে থাকে  এর মূলে ছিল জেরুজালেমের মর্যাদা, বসতি সম্প্রসারণ ও ফিলিস্তিনি অধিকার নিয়ে বিরোধ। সর্বশেষ ২০২৩ সালে শুরু হওয়া ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত চলছে গাজায় ইজরায়েলের বর্বর হামলায় এখন পর্যন্ত ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ শাহাদত বরণ করেন।  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, এক লাখ ১০ হাজার ৪৫৩ জন ফিলিস্তিনি এই সংঘর্ষে আহত হয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তেসরা জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে জানায়, এই আহতদের মধ্যে ২৫ শতাংশের আঘাত এতোটাই গুরুতর যে তাদের জীবন আর আগের অবস্থায় ফিরবে না।  সহিংসতার অবসানের জন্য ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে ইসরায়েল গত মঙ্গলবার থেকে ফের গাজায় ভয়াবহ হামলা শুরু করেছে। আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫০৬ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। এর মধ্যে ২০০ শিশু রয়েছে। গত তিন দিনে গাজা উপত্যকায় আহত হয়েছেন আরও ৯০৯ জন।  ( আল জাজিরার) ।  এটি ছাড়াও মধ্য প্রাচ্যের প্রতিটি দেশের সাথেই ইজরায়েল নানা সময়ে সংঘাতে জড়িয়েছে বারবার মানবতার লঙ্ঘন করেছে নজিরবিহীন হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে  শান্তির নগরীকে করেছে অশান্ত।  বেলফোর ঘোষণা মধ্য প্রাচ্যের  স্বার্বভৌমত্বকে আজ হুমকিতে ফেলেছে। 

লেখক :শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


ডেল্টা টাইমস/নাইমুর রহমান/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com