রমজানে শান্তির বদলে অপরাধের ছায়া
মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম:
প্রকাশ: রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৫, ১:১৩ পিএম আপডেট: ২৩.০৩.২০২৫ ১:১৭ পিএম

রমজানে শান্তির বদলে অপরাধের ছায়া

রমজানে শান্তির বদলে অপরাধের ছায়া

পবিত্র রমজান মাস মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধি, সংযম ও সহমর্মিতার এক মহিমান্বিত অধ্যায়। এই মাসে ধর্মপ্রাণ মানুষ রোজা রাখেন, বেশি বেশি ইবাদত করেন এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি দেখান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এবারের রমজান মাসে বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, নির্যাতন, ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি আমাদের সমাজের অবক্ষয় এবং আইনশৃঙ্খলার চরম দুর্বলতাকে তুলে ধরে।

অপরাধের বৃদ্ধির কারণ: রমজান মাসে মানুষের ব্যস্ততা বাড়ে, বাজারে কেনাকাটার ধুম পড়ে, এবং সাধারণত রাতে মানুষের চলাচল বেশি হয়। অপরাধীরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যায়। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও অন্যান্য বড় শহরগুলোতে চুরি, ছিনতাই, এবং ডাকাতির মতো অপরাধ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

অর্থনৈতিক চাপ: বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কর্মসংস্থানের অভাব ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির ফলে অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা ও অপরাধীদের শাস্তির অভাব: পুলিশের টহল ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দুর্বলতা স্পষ্ট। অপরাধীরা ধরা পড়লেও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে তারা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। ফলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। দীর্ঘসূত্রিতা ও দুর্বল আইনি কাঠামো অপরাধ দমনে ব্যর্থ হচ্ছে। অপরাধীদের দ্রুত ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি: প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধ করে পার পেয়ে যায়।
সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়: সমাজে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। রমজানের সংযম ও মানবিকতার শিক্ষা অনেকেই ভুলে গিয়ে নিজেদের স্বার্থে অপরাধ করছে। ধর্মীয় শিক্ষা থাকলেও তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

নারীদের জন্য অনিরাপদ পরিবেশ: রমজান মাসে ইফতার ও সেহরির সময় নারীদের চলাচল বেড়ে যায়, ফলে তারা আরও বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ে। বাস, রিকশা, সড়ক, এমনকি কর্মস্থলেও তারা যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে, যা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরে।

বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য: রমজান এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। সরকারের কঠোর নজরদারির অভাব ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। এ বছর চাল, ডাল, তেল এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সাধারণ জনগণ দিশেহারা, কিন্তু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অপরাধের সমাধান ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপ: রাত্রিকালীন টহল বাড়ানো। সিসিটিভি মনিটরিং বৃদ্ধি। দ্রুত বিচার কার্যক্রম চালু করা। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনা।

অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। অপরাধীদের জামিনের সুযোগ কমিয়ে শাস্তি কার্যকর করা। ধর্ষণ, ডাকাতি ও হত্যার ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।

অর্থনৈতিক সহায়তা ও কর্মসংস্থান: দরিদ্রদের জন্য বিশেষ রেশন ব্যবস্থা চালু করা। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান।

নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: নারীদের জন্য বিশেষ হেল্পলাইন চালু করা। গণপরিবহনে নারীদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নারীর প্রতি সহিংসতার মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা।

বাজার নিয়ন্ত্রণ: সরকারিভাবে নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করা। সিন্ডিকেট ভাঙতে কঠোর আইন প্রয়োগ করা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজারে নজরদারি করা।

সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার: পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা জোরদার করা। ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে নৈতিকতা ও সততার শিক্ষা প্রচার করা। স্থানীয় সমাজ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে অপরাধীদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা।

সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও করণীয়: এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য শুধুমাত্র সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করলে হবে না, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরাধ হ্রাস করতে পারে।

পরিবারের ভূমিকা: অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা, তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অপরাধের কুফল সম্পর্কে অবগত করা জরুরি।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আলেমসমাজের ভূমিকা: মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অপরাধবিরোধী বার্তা প্রচার করতে হবে। ধর্মীয় নেতাদের উচিত মানুষকে সৎ পথে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

সচেতন নাগরিকদের ভূমিকা: সাধারণ জনগণকেও অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, অপরাধ প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখলে দ্রুত প্রশাসনকে অবহিত করতে হবে।

উপসংহার: রমজান মাস শান্তি, সহমর্মিতা ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। কিন্তু যদি এই মাসেই আমরা চরম অস্থিরতা ও অপরাধের শিকার হই, তাহলে তা সমাজের জন্য এক অশনি সংকেত। এখনই সময় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার, নাহলে অপরাধের এই প্রবণতা আমাদের ভবিষ্যৎকে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে। সমাজের প্রত্যেক সদস্যকেই এগিয়ে আসতে হবে, যাতে রমজানের প্রকৃত শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।


ডেল্টা টাইমস/মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com