বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সামাজিক অস্থিরতা
সাদিয়া সুলতানা রিমি:
|
![]() বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সামাজিক অস্থিরতা বাংলাদেশে উৎপাদনশীল খাত বিশেষ করে কৃষি ও শিল্পখাতে কাঙ্ক্ষিত হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। অপরদিকে, জনসংখ্যা ও ভোক্তা চাহিদা বাড়ছে, ফলে বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। এটি পণ্যের মূল্য বাড়ার অন্যতম কারণ।বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত দুর্বলতা, রিজার্ভ কমে যাওয়া, এবং আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধির ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। টাকার মান কমে যাওয়ায় বিদেশি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশীয় বাজারেও।সরবরাহ চেইনে অসংখ্য মধ্যস্বত্বভোগী ও দালাল চক্র পণ্যের দামে অযৌক্তিক বৃদ্ধি ঘটায়। বাজার মনিটরিংয়ের অভাবে এই চক্র সক্রিয় থেকে যায়। অনেক সময় সরকারি নীতির দুর্বলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এই অবস্থাকে আরও প্রকট করে।জ্বালানি বিশেষত ডিজেল ও গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। ফলে কৃষি ও শিল্পপণ্য থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্যের দামও বেড়ে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার ফলে বাংলাদেশের আমদানি খরচ বেড়েছে, যা জ্বালানি বাজারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে।এছাড়া খরা, বন্যা, নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের কৃষিখাতে বড় ধরনের ক্ষতি করে। এতে একদিকে উৎপাদন হ্রাস পায়, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা দাম বাড়িয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে। খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা—সব খাতে ব্যয় বাড়ায় পরিবারগুলো সীমাহীন কষ্টের মুখোমুখি হয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের আয় স্থির থাকলেও ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে, ফলে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ায় সমাজে চুরি, ছিনতাই ও অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। এমনকি শিক্ষিত যুবসমাজের একটি অংশ অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনে ঝুঁকে পড়ছে।মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা তাদের খরচ সামলাতে না পেরে কর্মী ছাঁটাই করে। অন্যদিকে নতুন চাকরি সৃষ্টি না হওয়ায় বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে, যা তরুণদের হতাশাগ্রস্ত করে তোলে এবং অস্থিরতা তৈরি করে।এছাড়া মুল্যবৃদ্ধি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে, যা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই অসন্তোষকে আন্দোলনের ইন্ধন হিসেবে ব্যবহার করে, ফলে সুশাসন ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়। সরকার কখনো কখনো নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা বাস্তবায়নে যথাযথ মনিটরিং ও কঠোরতা থাকে না। টিসিবি পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত নীতির অভাব স্পষ্ট। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় স্বতন্ত্র বাজার তদারকি কমিটি গঠন করে নিয়মিতভাবে বাজার পরিদর্শন, পণ্যের মূল্য যাচাই ও প্রয়োজন অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করতে হবে।কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বাড়াতে প্রণোদনা, ভর্তুকি ও কৃষিঋণের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের উন্নত বীজ, সেচ সুবিধা ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে খাদ্যপণ্যের ঘাটতি কমবে।সরবরাহ ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। দুর্নীতিবাজ আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি খাদ্য গুদামে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন পুনর্নির্ধারণ, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সম্প্রসারণ এবং বেকার ভাতা চালু করলে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী কিছুটা স্বস্তি পাবে।ডিজেল-গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমিয়ে সৌরশক্তি ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। রেল ও নৌপথের উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবহন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সামাজিক অস্থিরতা একটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত সমস্যা। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন, উৎপাদন বাড়ানো এবং জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা গেলে দেশের সার্বিক অগ্রগতি নিশ্চিত হবে। লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস/সাদিয়া সুলতানা রিমি/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |