দক্ষিণ এশিয়ায় নব্য-উপনিবেশের অদৃশ্য রূপ
মো. ফাহিম আলী:
|
![]() দক্ষিণ এশিয়ায় নব্য-উপনিবেশের অদৃশ্য রূপ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য বিস্তারের সবচেয়ে কার্যকর প্রভাব দেখা যায় ‘ঋণফাঁদ কূটনীতি’র ক্ষেত্রে। চীন এই নীতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল করে তুলছে। একই সঙ্গে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বাড়িয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার-নির্ভর হেজেমনি তৈরির চেষ্টা করছে। যার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (CPEC) প্রকল্প। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ও QUAD এর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলে চীনের প্রভাব মোকাবেলার চেষ্টা করছে। এটি এক প্রকার প্রভাব প্রতিরোধ নীতি, যা চীনের সম্প্রসারণবাদী নীতিকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল। দক্ষিণ এশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক চোকপয়েন্ট যেমন- মালাক্কা প্রণালী, হরমুজ প্রণালী এবং বঙ্গোপসাগর এখন আন্তর্জাতিক সামরিক অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ এবং ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’ কৌশলের উদ্দেশ্য হলো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক ও বাণিজ্যিক বন্দরসমূহ স্থাপন করে “স্ট্র্যাটেজিক এনসার্কলমেন্ট” গড়ে তোলা। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর বা পাকিস্তানের গওয়াদার বন্দরের উন্নয়ন চীনের চোক পয়েন্ট কন্ট্রোলের দিকেই ইঙ্গিত করে, যা এক ধরনের নব্য-উপনিবেশিকতা প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেয়। এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ভারত নিজেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ ও ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি’ অনুসরণ করে ভারত নিজস্ব বলয় সম্প্রসারণে ও চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সচেষ্ট। ফলে, অঞ্চলটিতে একটি শক্তির ভারসাম্য গড়ে উঠছে, যার ফলে দক্ষিণ এশিয়া একটি প্রক্সি সংঘাতের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। রাশিয়া দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নীরব কিন্তু সুসংগঠিতভাবে ভূমিকা রাখছে। ‘ব্যালান্সড মাল্টিপোলার কৌশল’ অনুসরণ করে রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি এবং অস্ত্রবাণিজ্য ও জ্বালানি নির্ভর সম্পর্কের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি মাল্টিপোলার ওয়ার্ল্ড অর্ডার দৃশ্যমান, যেখানে একক কোনো পরাশক্তি নেই; বরং অনেকগুলো শক্তি পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে নিজেদের বলয় বিস্তারে লিপ্ত। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর চীন ও রাশিয়া একদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা অন্যদিকে প্রভাব বলয়ের গেমে নেমেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট বা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া — এসবই জিওপলিটিকাল লিভারেজের অংশ। পরাশক্তিগুলো এসব সংকটকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছে। এখনকার পরাশক্তিরা শুধু সামরিক বা রাজনৈতিক নয়, বরং সফট পাওয়ার ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে কালচারাল হেজেমনি প্রতিষ্ঠায়ও লিপ্ত। মার্কিন পপ কালচার, হলিউড কিংবা ভারতের বলিউড — এসব বিশ্বমিডিয়া ও সাংস্কৃতিক রফতানির মাধ্যমে বৈশ্বিক মানদণ্ড তৈরি করেছে, যার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার স্থানীয় সংস্কৃতিগুলো ক্রমাগত বিশ্বায়িত আধিপত্যের ছায়ায় চলে যাচ্ছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় এখন ডিজিটাল উপনিবেশবাদের বিস্তার ঘটছে তথ্য ও প্রযুক্তির উপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থাগুলো অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর ডেটা সংগ্রহ করে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের গুগল ও ফেসবুক বাংলাদেশের মতো দেশের অনলাইন বিজ্ঞাপন বাজারের বিশাল অংশ দখল করেছে। চীন নিজস্ব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম (যেমন TikTok, WeChat, Alibaba) নির্মাণ করে বিকল্প আধিপত্য গড়ে তুলছে। অন্যদিকে ভারত স্থানীয় প্রযুক্তি উদ্যোগ এবং ডিজিটাল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিজস্ব বলয় নির্মাণে সচেষ্ট। এই প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া এক ধরনের নব্য উপনিবেশিক সংকটে পড়েছে, যেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে নেটওয়ার্ক ও অ্যালগরিদমের মাধ্যমে। আবার সেই সাথে এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ ও রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য নিরন্তর প্রতিদ্বন্দ্বিতা দৃশ্যমান। চীনের দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, ভারত ও পাকিস্তানের কাশ্মীর বিতর্ক, ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যা — এসবই অঞ্চলটিতে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে এবং একে অন্যের উপর নিরবচ্ছিন্ন চাপ সৃষ্টি করছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সম্পদ দখলের লড়াইয়ের ফলে এই অঞ্চলে বৈষম্য গভীরতর হচ্ছে, যেখানে দরিদ্র দেশগুলো উন্নত পরাশক্তির স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব পরিস্থিতি আধুনিক নব্য-উপনিবেশবাদের নির্দিষ্ট রূপ প্রকাশ করে, যেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ চলছে। সবশেষে বলা যায়, এশিয়ায় নব্য উপনিবেশবাদের সম্ভাবনা বাস্তব এবং তা অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান। শক্তিশালী দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করছে। তবে এর মোকাবিলায় এশিয়ার দেশগুলোকে অভ্যন্তরীণ সংহতি বাড়াতে হবে, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হবে এবং বহিরাগত নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এককথায়, নব্য উপনিবেশবাদ এশিয়ার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে তা প্রতিরোধ করা অসম্ভব নয়। লেখক : ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস/মো. ফাহিম আলী/সিআর/এমই |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |