প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫, ১২:৩৪ পিএম

বিশ্ব বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এক উত্তাল স্রোতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রতিটি খাতে অভাবনীয় পরিবর্তন আনছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, এমনকি নীতিনির্ধারণ পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রই এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং উন্নয়নের ধারায় নিজেকে শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য পাঠ্যক্রমে এআই-এর সংযোজন এখন আর বিলাসিতা নয়; এটি সময়ের দাবি। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষাভিত্তিক এবং অনেকাংশে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যখন বিশ্বজুড়ে ছাত্রছাত্রীরা রোবটিক্স, মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করছে, তখন আমাদের শিক্ষার্থীরা এখনো অতীতপন্থী পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ থাকলে তাদের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে। প্রযুক্তি নির্ভরতার এই যুগে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্লেষণী চিন্তাশক্তি, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী মনোভাব গড়ে তুলতে এআই-এর সঙ্গে তাদের পরিচয় জরুরি। তাই আজ প্রয়োজন বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমকে যুগোপযোগী করে তোলা এবং তাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক ধারণা ও ব্যবহারিক প্রয়োগ যুক্ত করা। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের তৈরি করতে পারবে, যা ভবিষ্যতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে এআই-এর গুরুত্ব

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু প্রযুক্তি খাতেই নয়, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, উৎপাদনশিল্প, আর্থিক খাত, এমনকি সৃজনশীল শিল্পেও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের দুয়ার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ দেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ, তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, দক্ষতার অভাবে এই তরুণ শক্তির একটি বড় অংশ কর্মসংস্থানের বাইরে থেকে যাচ্ছে। যদি এখনই শিক্ষা ব্যবস্থায় এআই সংযুক্ত করে শিক্ষার্থীদের এই নতুন প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দেশব্যাপী বেকারত্ব আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। শুধু চাকরির ক্ষেত্রেই নয়, উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতিতেও এআই বিশাল পরিবর্তন আনতে সক্ষম। বিশ্বব্যাপী গুগল, অ্যামাজন, টেসলার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আজ এআই-এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই সুযোগ রয়েছে, যদি শিক্ষার্থীরা এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারে। বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইনিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোর ভবিষ্যত এআই ভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে, যেখানে দক্ষ এআই কর্মীদের চাহিদা দিন দিন বাড়বে। যদি দেশের পাঠ্যক্রমে এখনই এআই অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে নতুন প্রজন্ম এই বৈশ্বিক চাহিদার সাথে নিজেদের মেলে ধরতে পারবে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। অর্থাৎ, পাঠ্যক্রমে এআই সংযুক্তির মাধ্যমে শুধু ব্যক্তি নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিত করা সম্ভ
শিক্ষা ব্যবস্থায় মান উন্নয়ন ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা

বর্তমানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ইতিমধ্যেই তাদের পাঠ্যক্রমে এআই বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করেছে। শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, মাধ্যমিক এমনকি প্রাথমিক শিক্ষাতেও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিনির্ভর চিন্তা গড়ে তুলতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক শিক্ষা মানের সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে চায়, তাহলে আমাদেরও এখনই এই ধারা অনুসরণ করা প্রয়োজন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের এআই-এর মৌলিক ধারণা দেওয়া, সিনিয়র পর্যায়ে প্রজেক্টভিত্তিক কাজের মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করানো এবং উচ্চশিক্ষায় গবেষণাভিত্তিক এআই শিক্ষা চালু করা জরুরি। এইভাবে ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলা গেলে তারা দেশ-বিদেশে প্রতিযোগিতামূলক চাকরি ও গবেষণার সুযোগ লাভ করতে পারবে। অন্যথায়, তারা শুধু দেশীয় সীমিত পরিসরে আটকে থাকবে এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। আজকে আমাদের শিক্ষার্থী যদি "ডেটা অ্যানালিটিক্স," "নিউরাল নেটওয়ার্ক," "মেশিন লার্নিং মডেল," "প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং" ইত্যাদি বিষয়গুলোর মৌলিক ধারণা না রাখে, তাহলে আগামী দশকের কর্মসংস্থানের বাজারে তাদের কোনো জায়গা থাকবে না। তাই পাঠ্যক্রমে এআই সংযুক্তি কেবল প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ তৈরি করবে না, বরং শিক্ষার মানও বহুলাংশে উন্নত করবে এবং বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে অগ্রসর করবে।

নৈতিকতা, নিরাপত্তা ও সৃজনশীল ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতি

এআই শুধু সম্ভাবনার দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়; এর সঙ্গে সম্পর্কিত রয়েছে নৈতিকতা, নিরাপত্তা এবং সঠিক ব্যবহারের প্রশ্নও। বিশ্বব্যাপী এখন এআই ব্যবহারে তথ্যের গোপনীয়তা, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো, অটোমেশনজনিত কর্মসংস্থান হারানো ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এআই ব্যবহারের নৈতিক দিকগুলো শেখানোর ব্যবস্থা না করে, তাহলে ভবিষ্যতে অনিয়ন্ত্রিত এআই ব্যবহারের ফলে নানা সামাজিক ও নৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। তাই পাঠ্যক্রমে এআই সংযুক্তির সময় শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা নয়, এর নিরাপদ ও নৈতিক ব্যবহার সম্পর্কেও শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। যেমন, কীভাবে তথ্যের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হয়, কিভাবে এআই-এর মাধ্যমে ভুল বা ক্ষতিকর তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে হয়, কীভাবে এআই-কে সৃজনশীলতার জন্য ব্যবহার করা যায়, ইত্যাদি বিষয় শিক্ষার্থীদের শেখানো জরুরি। এর ফলে তারা ভবিষ্যতে শুধু দক্ষ কর্মীই হবে না, দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবেও গড়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের তরুণ সমাজ যদি নৈতিকভাবে সচেতন হয়ে এআই ব্যবহার করতে পারে, তাহলে প্রযুক্তি হবে তাদের হাতিয়ার—ধ্বংসের নয়, গঠনমূলক উন্নয়নের মাধ্যম। ফলে এআই সংযুক্ত পাঠ্যক্রম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সমাজ গঠনের জন্যও অপরিহার্য হয়ে উঠবে।

বিশ্বের অগ্রসরমান প্রযুক্তি যুগে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের জন্য আর দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাকে দ্রুত সংযুক্ত করা এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি। পাঠ্যক্রমে এআই যুক্ত করলে শিক্ষার্থীদের শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়বে না, তাদের বিশ্লেষণী চিন্তা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং নৈতিকতা বোধও গড়ে উঠবে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন সহজতর হবে। এআই হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি। তাই এখনই সময় — শিক্ষা নীতিমালায় যুগোপযোগী পরিবর্তন এনে, সৃজনশীল ও নৈতিকভাবে দক্ষ একটি তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলার। আধুনিক বিশ্বে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য আজকের উদ্যোগই হতে পারে আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের মূল ভিত্তি।


ডেল্টা টাইমস/হৃদয় পান্ডে/সিআর/এমই