নারী নেতৃত্ব ও সামাজিক স্টেরিওটাইপের বেড়াজাল পেরিয়ে সম্ভাবনার দিগন্ত
হৃদয় পান্ডে:
প্রকাশ: বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫, ১১:৩০ এএম

নারী নেতৃত্ব ও সামাজিক স্টেরিওটাইপের বেড়াজাল পেরিয়ে সম্ভাবনার দিগন্ত

নারী নেতৃত্ব ও সামাজিক স্টেরিওটাইপের বেড়াজাল পেরিয়ে সম্ভাবনার দিগন্ত

কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগের বিষয়টি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বা পেশাগত উন্নতির জন্যই নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্যও অপরিহার্য। বৈষম্যহীন, টেকসই সমাজ গঠনের জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমান সুযোগ ও পরিসর নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি একদিকে যেমন মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীক, তেমনি অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি প্রধান স্তম্ভ। আজকের বিশ্বে আমরা অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছি, কিন্তু এখনো কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। যা তাদের পেশাগত উন্নতি ও কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ পেতে বাধা সৃষ্টি করে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর উৎস অনেক গভীরে নিহিত, যা সামাজিক প্রথা, পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি, আর্থিক পরিস্থিতি এবং দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংস্কৃতির ভেতর থেকে উঠে এসেছে।

প্রথমত, কর্মক্ষেত্রে নারীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য। আজও দেশে অধিকাংশ নারীরা পুরুষের তুলনায় কম পারিশ্রমিক পান, যদিও তারা একই কাজ বা দক্ষতার অধিকারী। এই বেতন বৈষম্য শুধু নারীর আর্থিক স্বাধীনতা হ্রাস করে না, বরং এটি তাদের পেশাগত মনোবলকেও নষ্ট করে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা নিজেদের পেশাগত দক্ষতা ও পরিশ্রমের যথার্থ মূল্য পায় না, ফলে তাদের মধ্যে কর্মস্পৃহা ও পেশাগত দায়িত্ববোধে প্রভাব পড়ে। বেতন বৈষম্য নারীর জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তাদের পরিবার ও সন্তানদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় হুমকি সৃষ্টি করে।

লিঙ্গভিত্তিক এই বেতন বৈষম্য দূর করার জন্য কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এর বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজন সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা, যা নিশ্চিত করবে যে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য বিদ্যমান নেই এবং সবার জন্য সমান পারিশ্রমিক প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে নারীদের দক্ষতার প্রতি আরও ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদানে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর ফলে নারীরা কর্মক্ষেত্রে আরও উৎসাহিত হয়ে কাজ করবেন এবং তাদের কর্মদক্ষতা আরও বাড়বে, যা প্রতিষ্ঠান ও দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যও সহায়ক হবে।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য সামাজিক স্টেরিওটাইপ এবং বৈষম্যমূলক মনোভাব অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আমাদের সমাজে এখনও অনেক ক্ষেত্রে মনে করা হয়, নারীদের পেশাগত দায়িত্ব সীমিত হওয়া উচিত এবং তাদের মূল কাজ হলো গৃহস্থালীর দায়িত্ব পালন করা। এই ধরনের পুরনো ধারণাগুলোর কারণে নারীরা প্রায়শই কর্মক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত সুযোগ ও সীমাবদ্ধ ভূমিকার সম্মুখীন হন। বিশেষত, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, বা উচ্চতর ব্যবস্থাপনাগত পদগুলোর ক্ষেত্রে নারীরা নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন, যেখানে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।

এই বৈষম্য ও স্টেরিওটাইপ দূর করতে হলে পরিবার, সমাজ, এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমে সমাজে প্রচলিত এই ভুল ধারণাগুলো দূর করতে হবে এবং নারীদের দক্ষতার প্রতি সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে তাদের জন্য আরও প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়ন কর্মসূচির আয়োজন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অপরিসীম, কারণ সরকারের উদ্যোগে এই ধরনের প্রশিক্ষণ ও কর্মসূচির আয়োজন করলে নারীরা আরও কর্মদক্ষতা অর্জন করবে এবং কর্মক্ষেত্রে সফলতার সাথে কাজ করতে পারবে।

নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো গৃহকর্ম এবং পেশাগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। বিশেষ করে বিবাহিত নারীরা সন্তানের যত্ন ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও কাজ করে থাকেন। অনেক সময় তাদের এই দ্বৈত দায়িত্ব পালনে মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি চলে আসে, যা তাদের কর্মদক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কর্মক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল পরিবেশ, কর্মঘণ্টা নিয়ে নমনীয়তা, এবং পরিবারের কাছ থেকে সহযোগিতা নারীদের কর্মজীবনকে আরও সহজ ও সুবিধাজনক করে তুলতে পারে।

এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারীর উন্নতির পথে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো কর্মক্ষেত্রে উন্নয়নের সুযোগ সীমিত থাকা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী কর্মীদের নির্দিষ্ট পদে আটকে দেওয়া হয়, এবং তাদের উচ্চতর পদে উন্নীত করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হয়। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, নারীদের নেতৃত্বের ভূমিকায় স্থান না দেওয়া। ফলে, তারা কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন।

কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে তোলা এবং তাদের যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন করার মাধ্যমে নারী কর্মীদের জন্য উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। তাদের ওপর দায়িত্ব এবং নেতৃত্বের সুযোগ প্রদান করতে হলে প্রতিষ্ঠানের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে এবং নারীদের জন্য একটি অনুকূল কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই ধরনের উদ্যোগ নারীদের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করবে এবং তাদের কর্মজীবনকে আরও স্থিতিশীল ও সফল করে তুলবে।

কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো নিরাপত্তা। অনেক সময় নারীরা সহকর্মীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন, যা তাদের কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার ইচ্ছা ও মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি নারীদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল করে তোলে এবং তাদের পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীদের কর্মক্ষেত্রে হয়রানি থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং একটি নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার, প্রতিষ্ঠান, এবং পরিবার একত্রে কাজ করলে নারীদের জন্য একটি সমতামূলক কর্মক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। নারীদের শিক্ষার উন্নয়ন এবং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচি। এর মাধ্যমে নারীরা নিজেদের যোগ্যতা আরও বাড়িয়ে কর্মক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থানে পৌঁছতে পারবে।

কর্মক্ষেত্রে নারীদের সঠিক মূল্যায়ন ও সমান সুযোগ প্রদানে উদ্যোগী হতে হলে পরিবার, সমাজ, এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়; বরং পুরো সমাজে নারীর প্রতি সম্মান ও সমতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নারীদের জন্য এই সমতার পরিবেশ গড়ে তুলতে সরকারি, বেসরকারি, এবং পারিবারিক উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্যোগগুলো নারীদের কর্মজীবনে আরও উৎসাহিত করবে এবং তাদের জন্য আরও সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করবে, যা কেবল তাদের জন্যই নয় বরং পুরো সমাজের জন্যই ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ। 

ডেল্টা টাইমস/হৃদয় পান্ডে/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com