যুদ্ধ নয়, মানবতা চাই: বিজ্ঞান, অস্ত্র এবং বৈষম্যের চক্রে বন্দী পৃথিবী
আশরাফুল মুহাম্মদ:
প্রকাশ: শনিবার, ১০ মে, ২০২৫, ১০:৩৫ এএম

যুদ্ধ নয়, মানবতা চাই: বিজ্ঞান, অস্ত্র এবং বৈষম্যের চক্রে বন্দী পৃথিবী

যুদ্ধ নয়, মানবতা চাই: বিজ্ঞান, অস্ত্র এবং বৈষম্যের চক্রে বন্দী পৃথিবী

পারস্যের বিখ্যাত কবি শেখ সাদীর কবিতা ‘বণি আদম’, যা জাতিসংঘের প্রবেশপথে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, মানবতার ডাক দিচ্ছে, মানুষকে একই সুতোয় বেঁধে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে। সেই কবিতার মতোই মানুষে মানুষে বিভাজনকে উপেক্ষা করে, যদি কবিতায় বর্ণিত শরীর অঙ্গের মতো আদম সন্তানরা একে-অপরের অংশ অনুধাবন করতো, তবে শরীরের এক অঙ্গ হয়ে অপর অঙ্গের ব্যথা অনুভব করার মতোই অপর মানুষ ভাইকে হত্যা করার ব্যাথা-বেদনা বুঝতে পারবে।

যুদ্ধে আর্থসামাজিক অবস্থা ও শান্তি নেতিবাচকভাবে পরিবর্তন নিয়ে আসে। যুদ্ধ সবর্দা মানুষের জন্য অকল্যাণকর এবং বিনাশকর। সেই প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সবগুলো ফলাফল হিসাবে জাতি-সমাজ-সংসারের ধ্বংস দেখাতে সক্ষম হয়েছে মাত্র। আজকের দিনেও ফিলিস্তিনের উপর বর্বরোচিত অত্যাচার-নির্যাতন এবং অবকাঠামো নির্মাণগুলোর ধ্বংসাবশেষ উদাহরণস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীর বুকে পূর্বের সংঘাতের ক্ষতচিহ্নগুলো এখনো মুছে যায়নি। তাসত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরাশক্তি একে-অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবার একেবারে দ্বারপ্রান্তে। এটা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম সংঘাত নয়, পূর্বেও তারা পৃথক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেও একাধিকবার দ্বন্দ্বে জড়িত হয়েছিল। পরস্পর রাষ্ট্র দু’টির সীমান্তবর্তী এলাকায় গুলিবর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল পান করাও স্বাভাবিক, কিন্তু এই দ্বি-রাষ্ট্রের সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করে স্থায়ীভাবে দ্বন্দ্ব নিরসন অসম্ভব। তারা পূর্বে একাধিক যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল৷ প্রত্যেকটি যুদ্ধ আন্তর্জাতিকভাবে সমঝোতা ও চুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেছিল। দিনশেষে পুনরায় একে-অপরকে দমনের চেষ্টা চালিয়ে ছিল। বর্তমানে পেহেলগামে হামলাকে কেন্দ্র করে পরস্পর রাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্র দুটি পুরোদমে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লে মানবসভ্যতার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার উপর বড় হুমকি হিসাবে দেখা যাবে। 

চলতি শতাব্দীকে বলা হয় বিজ্ঞানের শতাব্দী। গত শতাব্দী থেকে বর্তমান বিজ্ঞান তার ৯৯% আবিষ্কার করেছে। পূর্বে যা আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব খুবই সাধারণ জিনিসপত্র ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের উদ্ভাবনগুলো এতোটাই উন্নত যে অতীতে এইসব মানুষের কল্পনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে কল্পনার বাইরে ছিল। আজকের দিনে শহর থেকে গ্রাম বিজ্ঞানের বিস্তৃত ঘটেছে, শিল্পকারখানা থেকে কৃষিকাজ বাদ নেই কোথাও। সনাতন পদ্ধতিকে উপেক্ষা করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অল্প সময়ে অধিক উৎপাদন কাজ সম্ভব হয়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়: শতভাগ মানুষ কি তাদের মৌলিক অধিকার অর্জন করতে পারছে? বিজ্ঞান আশীর্বাদ হয়ে শতভাগ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হলেও এক নিমিষেই শতভাগ মানুষ ধ্বংস করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। গবেষণা সংস্থাগুলোর মতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পরমাণু অস্ত্র আছে ৬ হাজার ৮০০, রাশিয়ার ৭ হাজার, ফ্রান্সের ৩০০, যুক্তরাজ্যের ২১৫, চীনের ২৭০, ভারতের ১৩০, পাকিস্তানের ১৪০, ইসরাইলের ৮০, আর উত্তর কোরিয়ার আছে ২০টি । পৃথিবী এসব অস্ত্রের ভয়াবহতা ইতোমধ্যেই জাপানে লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যান নামক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে দেখেছে। লিটল বয় ৬ আগস্ট ১৯৪৫ সালে হিরোশিমাতে এবং ফ্যাট ম্যান তিনদিন পর জাপানের নাগাসাকিতে নিক্ষেপ হয়েছিল। যার ভয়াবহতা আজও মানুষের লোমহর্ষকের কারণ হয়ে আছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও ক্ষতিকর আলোক-কণা বিকিরণের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে মারা গিয়েছিল প্রায় ১২০,০০০ লোক এবং আয়নাইজিংয়ের ফলে ধীরে ধীরে আরো অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছিল। এতবড় সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ মাত্র দুটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে। পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের প্রারম্ভিক অবস্থায় এতো বৃহৎ ক্ষতি করেছিল। বর্তমানে এই অস্ত্র যেমন সংখ্যায় বেশি, তেমন অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন; আবার আকৃতিগত দিক থেকে পূর্বের থেকে অনেক ছোট। ফলে সহজেই অন্য দেশে আক্রমণ করতে সক্ষম।

পাকিস্তান এবং ভারত উপমহাদেশে দুটোই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। একবার কল্পনা করে দেখুন: তারা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে ফেলল। শুধু কি তাদের দুটো দেশে সীমাবদ্ধ থাকবে? নিশ্চিত করে বলতে পারি, ফলাফল হিসাবে পুরো উপমহাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। সারাবিশ্বে একটি অর্থনৈতিক নেতিবাচকতা দেখা মিলবে৷ একাধিক পরিপূরক রাষ্ট্রের সহোযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক ভেঙে দেবে। 

পৃথিবীর দিকে তাকালে দারিদ্রতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ পাওয়া যায় যুদ্ধকে এবং এর পাশে সম্পদের অনুপযুক্ত ব্যবহার। ‘যুদ্ধ’ এবং ‘সম্পদের অনুপযুক্ত ব্যবহার’ কারণ দুটির শাব্দিক অর্থ ভিন্ন, কিন্তু এদুটির ফলে সমাজে অভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে একটি দেখা গেলে, অপরটিও সংঘটিত হয়; এযেন পরস্পর একে-অপরের পরিপূরক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাংলায় “ পঞ্চাশের মন্বন্তর ” দুর্ভিক্ষ যা ১৯৪৩ সালে ঘটেছিল। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করে যে এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। এই দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল জাপান কতৃক মায়ানমার তৎকালীন বার্মা দখল এবং বার্মার চাল বাংলায় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়া। সেসময় বাংলা অঞ্চল ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ছিল। ব্রিটিশরা সুশাসন এদেশে দেখায়নি, তারা ‘স্কর্চড আর্থ’ নীতি ও রেশনিং ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এদেশে থাকা মজুদ উৎপাদন ভেঙে ফেলেছিল।  ফলে অদক্ষ অর্থনীতিক ব্যবস্থাপনায় ৩০ লক্ষ নারী-শিশু-কিশোর-যুবকের অকালে প্রাণ ঝরেছিল। যদি যুদ্ধ সংঘটিত না হতো, তবে পারস্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো থাকতো, আমদানি-রপ্তানি হতো। ফলে বিনাকারণে এতোগুলা প্রাণ ঝরে যেতো না। অর্থনীতিতে বৈষম্যের কারণে যুদ্ধ হয়; বিষয়টি  শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্বের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কার্ল মার্কস। বর্তমান বিশ্বেও আমরা সেরকম পরিস্থিতি লক্ষ্যভেদ করে যাচ্ছি। পৃথিবীর উভয় সমৃদ্ধ দেশ এবং নিম্নবর্গীয় দেশ উৎপাদন করে থাকে। সমৃদ্ধ দেশসমূহে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মারণাস্ত্র এবং নিম্নবর্গীয় দেশ মৌলিক চাহিদা সরবরাহ করে যাচ্ছে। মৌলিক চাহিদা পূরণ করা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য মারণাস্ত্রের মূল্যের সবসময় নিম্ন রেখায় অবস্থান করে আসছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত; দুটি বড় শ্রেণী ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে জন্মেছে। কোনো এক সময় এই নিম্নশ্রেণী তাদের মৌলিক অধিকার আদায় এবং সমৃদ্ধির জন্য উচ্চশ্রেণীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যদি উচ্চশিখরে থাকা শ্রেণী তাদের সম্পদের সুষম ব্যবহার না করে এবং নিম্ন শ্রেণীকে শোষণ থেকে মুক্তি না দেয়, তবে ভবিষ্যতে দুই শ্রেণী মানুষ যুদ্ধ করে ভারসাম্য অবস্থায় যেতে উদ্ধুদ্ধ হবে।

প্রাচীনকাল থেকে যুদ্ধ মানব সভ্যতায় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। যুদ্ধের অন্যতম কারণ দাম্ভিকতা-লুটপাট ইত্যাদি। কেউ নিজেকে শক্তিধর প্রমাণ করতে যুদ্ধবাজ হয়েছে। কেউ আবার রাজ্য বা দেশ দখল-লুটপাট করতে যুদ্ধ জড়িত হয়েছে। তবে আধুনিক যুগে জাতিগত বিভাজন যুদ্ধের মুখ্য কারণ। জাতিগত দাম্ভিকতায় আমরা নিজেদেরকে মানুষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিনা। বরং আমরা নিজেদের দাবি করি সাদা-কালো, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-কনফুসিয়াস-জৈন- ইহুদি, বাঙালি-ভারতীয়-চাকমা-আমেরিকান-রাশিয়ান-এশিয়ান-ইউরোপিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান নিক্তিতে। আমি মনে করি, পৃথিবীর মানুষ যেদিন সত্যিকার মানুষ ভাবতে পারবে। ঠিক সেদিন থেকে যুদ্ধ নামক শব্দ পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত করতে পারবে এবং পৃথিবীতে অর্থনীতির ভারসাম্য সকল দেশে সমান হবে। থাকবে না কোনো দুর্ভিক্ষ; অকারণে পতিত হবে না কোনো প্রাণ।


লেখক : ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ডেল্টা টাইমস/আশরাফুল মুহাম্মদ/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com