সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন : বন্ধুত্বের মুখোশে ভারতের আগ্রাসন
ফাহিম হাসনাত:
|
![]() সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন : বন্ধুত্বের মুখোশে ভারতের আগ্রাসন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিস্তৃত সীমান্তজুড়ে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা একটি নিয়মিত ও ভয়াবহ চিত্র। বাংলাদেশ সরকার বহুবার এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড বন্ধের জোরালো দাবি জানালেও ভারত বিভিন্ন সময়ে লোক দেখানো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। তবে, দীর্ঘকাল ধরে সীমান্তে রক্ত ঝরলেও, একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে দীর্ঘদিনের শেখ হাসিনার সরকার এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের হাল ধরেছে। এই নতুন সরকার ভারতের অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে একটি ভারতীয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ভারত যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করে, তবে তাদের ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোও অস্থিরতার লেলিহান শিখা থেকে রেহাই পাবে না। এই বলিষ্ঠ বার্তা দিয়েই তিনি কার্যভার গ্রহণ করেছেন এবং ভারতের যেকোনো অন্যায় ও অযৌক্তিক বিবৃতির তাৎক্ষণিক ও কঠোর জবাব দিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের এই অনমনীয় মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও নতুন করে সাহস সঞ্চয় করছে এবং ভারতের অন্যায্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এর বেশ কিছু স্পষ্ট দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। কিছুদিন আগে দিনাজপুরের বিরল সীমান্ত এলাকা থেকে বিএসএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে দুই নিরীহ কৃষি শ্রমিককে ধরে নিয়ে গেলে স্থানীয় শত শত মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হয়ে ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে দু'জন ভারতীয় নাগরিককে ধরে আনে। পরবর্তীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বিএসএফের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে উভয় দেশের অপহৃত নাগরিকদের ফেরত দেওয়া হয়। এর আগে জানুয়ারী মাসে কালিগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের আকস্মিক সৈন্য মোতায়েনকে কেন্দ্র করে বিজিবি সদস্যদের সাথে সংঘর্ষের উপক্রম হলে স্থানীয় শত শত সাধারণ মানুষ লাঠি-সোটা নিয়ে বিএসএফের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এছাড়াও, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌকা সীমান্তে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে শূন্যরেখার ১০০ গজের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ভারতীয় অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিজিবি যখন জোরালো প্রতিবাদ জানায়, তখন ভারত পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাগুলো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে ভারতের অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে না। তবে, অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, এত কিছুর পরেও বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও গুলি করা বন্ধ করেনি। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত দশ বছরে বিএসএফ নির্মমভাবে ৩০৫ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। শুধু ২০২৪ সালেই প্রাণ হারিয়েছে ২৬ জন এবং ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত আরও পাঁচজন নিরীহ বাংলাদেশীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে সীমান্ত। এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আজ পর্যন্ত কোনো প্রকার বিচার হয়নি। অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য আরও ভয়াবহ, তাদের মতে গত ১৬ বছরে বিএসএফ প্রায় ৬০০ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে, যার অধিকাংশই সংঘটিত হয়েছে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা শেখ হাসিনার শাসনামলে। এই ধারাবাহিকতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, গত ২রা মে (বৃহস্পতিবার) রাতে ঝিনাইদহের মহেশপুরে বিএসএফ গুলি করে আরও এক বাংলাদেশীকে গুরুতরভাবে আহত করেছে। অথচ বিস্ময়করভাবে, চীন, পাকিস্তান বা নেপালের স্পর্শকাতর সীমান্তে ভারত সর্বদা সতর্ক থাকে, কিন্তু রহস্যজনকভাবে বাংলাদেশ সীমান্তে তারা যেনো বেপরোয়া ও অমানবিক হয়ে ওঠে। বিএসএফের হাত থেকে রক্ষা পায়নি কোমলমতি শিশু-কিশোররাও। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানী খাতুন নামের এক ১৫ বছর বয়সী কিশোরীকে বিএসএফ পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে এবং তার নিথর দেহ দীর্ঘ সময় কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা হয়, যা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার কর্মীদের তীব্র সমালোচনার ঝড় তোলে। তবে, আন্তর্জাতিক মহলের এত নিন্দার পরেও ফেলানী হত্যার সাথে জড়িত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষসহ অন্যান্যরা ভারতের আদালতে নির্লজ্জভাবে খালাস পায় এবং সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হলেও আজও সেই বিচারপ্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়াও, বিএসএফ ২০২৪ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্বর্ণা দাস এবং ১৫ বছর বয়সী জয়ন্ত কুমার সিংহকেও ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। তবে, এই অন্ধকার চিত্রের মাঝে আশার ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে এই কারণে যে, সীমান্ত থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ভেতরের সাধারণ জনগণ পর্যন্ত এখন ভারতের এই আগ্রাসী ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক মনোভাব ধারণ করেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও (বিজিবি) সীমান্তে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে এবং কোনো প্রকার ছাড় দিতে নারাজ। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে বাংলাদেশকে যেভাবে ভারতের হাতের পুতুল বানানো হয়েছিল, সেই কলঙ্কজনক অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার অন্ধ মোহে তিনি দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতকে উজাড় করে সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি নির্লজ্জভাবে নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, ভারতকে তিনি যা দিয়েছেন, ভারত তা সারাজীবন কৃতজ্ঞতার সাথে মনে রাখবে। ট্রানজিটের নামে বাংলাদেশের বুক চিরে করিডোর প্রদান, বিনামূল্যে পণ্য পরিবহন, নিজেদের বন্দর ব্যবহারের অবাধ সুযোগ এবং একতরফা বাণিজ্যের অবারিত দ্বার উন্মোচন করে তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করেছিলেন। বিনিময়ে বাংলাদেশ কার্যত কিছুই পায়নি। উল্টো তার সরকারের একজন মন্ত্রী ঔদ্ধত্যের সাথে বলেছিলেন যে, ভারতের কাছে কিছু চাইতে তাদের লজ্জা লাগে। বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ যে ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করে, ভারত সম্ভবত আজও সেই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারছে না। বারবার বুঝিয়ে দেওয়ার পরেও তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি, যা তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতারই সুস্পষ্ট পরিচায়ক। পর্যবেক্ষকদের মতে, যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রই ভারতের অন্যায্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, ভারত তাদের কিছুই করতে সক্ষম হয়নি। মালদ্বীপ তাদের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে গেছে। নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো তাদের অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদ করে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ায় ভারত নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছে। কয়েক বছর আগে নেপাল আকস্মিকভাবে খাদ্য আমদানি বন্ধ করে দিলে, এর প্রতিক্রিয়ায় নেপাল যখন ভারতের সকল টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়, তখন ভারত স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে বাধ্য হয়। এমনকি ভুটানও পানি বণ্টন বন্ধের মতো কঠোর পদক্ষেপের হুমকি দিলে ভারত পিছু হটতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের মানুষও এখন ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে যে, ভারতকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে পারলেই তারা সঠিক পথে আসবে। তারা শক্তির পূজারী এবং দুর্বলদের প্রতি নির্দয় আচরণ করাই তাদের স্বভাব। তাই তাদের নমনীয় হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। শেখ হাসিনা ভারতের সাথে ট্রানজিট, বিনামূল্যে পণ্য পরিবহনসহ দেশের স্বার্থবিরোধী যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি অবিলম্বে সেগুলো বাতিল করে, তবে ভারতের কার্যত কিছুই করার থাকবে না। ইতোমধ্যে এসব বিতর্কিত চুক্তি বাতিলের জোরালো দাবি উঠেছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকেও এই বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এরপর দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে সমতার ভিত্তিতে নতুন চুক্তি করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ভারতকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া আত্মঘাতী হবে। লেখা: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেল্টা টাইমস/ফাহিম হাসনাত/সিআর/এমই
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |