যুদ্ধের নতুন মাত্রা: ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ইতিহাসের প্রথম ‘ড্রোন ফ্রন্টলাইন’
প্রজ্ঞা দাস:
প্রকাশ: সোমবার, ১২ মে, ২০২৫, ১:২৮ পিএম

যুদ্ধের নতুন মাত্রা: ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ইতিহাসের প্রথম ‘ড্রোন ফ্রন্টলাইন’

যুদ্ধের নতুন মাত্রা: ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ইতিহাসের প্রথম ‘ড্রোন ফ্রন্টলাইন’

যুদ্ধের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আকাশ থেকে নয়, কিন্তু নীরব, অদৃশ্য ড্রোনের ঝাঁক থেকে মৃত্যু নেমে এলো।১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বারবারই রক্তাক্ত হয়েছে। তবে ২০২৫ সালের মে মাসে শুরু হওয়া সর্বশেষ সংঘাত যুদ্ধের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে , তা হলো ড্রোন ফ্রন্টলাইন। এই সংঘাতে ড্রোন প্রযুক্তির অভূতপূর্ব ব্যবহার কেবল যুদ্ধের কৌশলই বদলে দেয়নি, বরং আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং যুদ্ধনীতির ক্ষেত্রে নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং পাকিস্তানের পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ড্রোন যুদ্ধের যে অধ্যায় শুরু হয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী সামরিক কৌশল ও নৈতিকতার প্রশ্নকে নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। 

২০২৫ সালের ৬ মে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর অধীনে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ, কোটলি এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুরসহ ছয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।ভারতের দাবি, এই হামলার লক্ষ্য ছিল লস্কর-ই-তইয়বা এবং জয়শ-ই-মোহাম্মদের সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করা। এই অভিযানে হার্পি এবং হারোপ ড্রোনের ব্যবহার ভারতের সামরিক কৌশলের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এই ড্রোনগুলো, ইসরায়েলি প্রযুক্তির ফসল যা শত্রুপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ভারতের এই হামলায় সাধারণ নাগরিক, এমনকি শিশুরাও নিহত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তানও পাল্টা হামলায় ড্রোন ব্যবহার করে, যার মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড সদর দপ্তর ধ্বংসের দাবি উঠে আসে। এই ঘটনা বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ‘ড্রোন ফ্রন্টলাইন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। যেখানে উভয় পক্ষই ড্রোনকে প্রাথমিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।

যদিও ড্রোন যুদ্ধের এই নতুন যুগের শুরু ঐতিহাসিকভাবে। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ড্রোন হামলা শুরু করলেও, তা মূলত নজরদারি ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাতের জন্য ব্যবহৃত হতো।ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ড্রোনের ব্যবহার এই প্রযুক্তিকে একটি সম্পূর্ণ ফ্রন্টলাইন অস্ত্রে রূপান্তরিত করেছে। উভয় দেশের সামরিক বাহিনী শত শত ড্রোন মোতায়েন করেছে, যার মধ্যে ভারতের এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাকিস্তানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। পাকিস্তানেরও দাবি, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে, যদিও ভারত এই তথ্য অস্বীকার করে।এই ড্রোন-কেন্দ্রিক যুদ্ধের ফলে নিয়ন্ত্রণ রেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে অভূতপূর্ব উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, যা বিশ্বকে পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের সংঘাতের ভাবনায় ভীত করছে।
পাশাপাশি ড্রোন যুদ্ধের উত্থান আন্তর্জাতিক আইনের জন্য একটি নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে।জেনেভা কনভেনশন, যা যুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি, তা বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং সশস্ত্র সংঘাতের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করে। কিন্তু ড্রোন প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এই আইনের প্রয়োগকে জটিল করে তুলেছে।ড্রোন হামলার ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তুর নির্বাচন, নির্ভুলতা এবং বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো নেই। ভারতের অপারেশন সিঁদুরে বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের ঘটনা এই সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে।পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারতের ড্রোন হামলায় মসজিদ এবং সাধারণ মানুষের বাসস্থান লক্ষ্যবস্তু হয়েছে, এমনকি ছোট শিশুরাও নিহত হয়েছে যা জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারত যদিও দাবি করে, তাদের হামলা সুনির্দিষ্ট এবং সন্ত্রাসী ঘাঁটির ওপর সীমাবদ্ধ ছিল। 

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দায়বদ্ধতা।ড্রোন হামলার ক্ষেত্রে কে দায়ী হবে , অপারেটর, সামরিক নেতৃত্ব, নাকি প্রযুক্তি নির্মাতা তার নির্ধারণও প্রশ্নবিদ্ধ ।ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে এই দায়বদ্ধতার প্রশ্ন আরো জটিল হয়ে ওঠে, কারণ উভয় দেশই একে অপরকে বেসামরিক হতাহতের জন্য দায়ী করেছে। এই সংঘাতে বেসামরিক জীবনের ক্ষয়ক্ষতি শুধু সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ, যারা দশকের পর দশক ধরে সংঘাতের মধ্যে বসবাস করছে, এই ড্রোন যুদ্ধের ফলে তারা আরো ভয়াবহ মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে।ড্রোনের নীরব উড়ান এবং অপ্রত্যাশিত হামলা সাধারণ মানুষের মধ্যে স্থায়ী ভীতি সৃষ্টি করে।এই পরিস্থিতি মানবাধিকারের মৌলিক নীতি, জীবন ও নিরাপত্তার অধিকারকে চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এই সংঘাতে উভয় পক্ষকে সংযত হবার আহ্বান জানান, কিন্তু ড্রোন যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করতে তিনি ব্যর্থ হন। এই আইনি শূন্যতা বিশ্বব্যাপী সামরিক প্রযুক্তির অপব্যবহারের সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ড্রোন যুদ্ধ শুধু আইনি ও মানবাধিকার সংকটই সৃষ্টি করেনি, এটি যুদ্ধনীতির নৈতিক ভিত্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।ড্রোনের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা একটি ‘পরিচ্ছন্ন যুদ্ধ’ হিসেবে উপস্থাপিত হতো, যেখানে সৈন্যদের সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই পরিচ্ছন্নতার পেছনে রয়েছে একটি অন্ধকার সত্য।ড্রোন অপারেটররা হাজার মাইল দূরে বসে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে, যা যুদ্ধের মানবিক দিককে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।এই দূরত্ব সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নৈতিক সংবেদনশীলতা হ্রাস করছে, যার ফলে বেসামরিক হতাহতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ড্রোন যুদ্ধের সূচনা ইতিহাসে এক ভয়াবহ মাইলফলক। যুদ্ধের মাঠে সেনাদের বদলে যখন যন্ত্র দাঁড়ায়, তখন তা প্রযুক্তির অগ্রগতি থাকে না , মানবতার পশ্চাৎযাত্রায় পরিগণিত হয়। এই সংঘাতে ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে যুদ্ধ যেমন আরও নিখুঁত ও দূরপাল্লার হলো, তেমনি তা আরও নির্মম এবং নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে।আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং যুদ্ধনীতির বহু প্রচলিত নীতি এই ড্রোন যুদ্ধের মুখে ধসে পরেছে। ভারত-পাকিস্তান দুই দেশই নিজেদের আত্মরক্ষার যুক্তি তুলে ধরলেও বাস্তবতা হলো সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ, যারা না এই যুদ্ধ চেয়েছে, না এ থেকে কিছু পেয়েছে। শুধুমাত্র যুদ্ধের ময়দানে মানবিকতা হেরে গিয়েছেন। এই বাস্তবতায় সামরিক কৌশলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতিতেও ড্রোন যুদ্ধের নীতিগত ও নৈতিক কাঠামো সংস্কার প্রয়োজন। অন্যথায়, ভবিষ্যতের যুদ্ধে মানুষ নয়, যন্ত্র নির্ধারণ করবে বেঁচে থাকার অধিকার এবং সভ্যতাকেও ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। যা কখনোই কাম্য নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।

ডেল্টা টাইমস/প্রজ্ঞা দাস/সিআর/এমই

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
  এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ  
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।

ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. জাহাঙ্গীর আলম, নির্বাহী সম্পাদক: মো. আমিনুর রহমান
প্রকাশক কর্তৃক ৩৭/২ জামান টাওয়ার (লেভেল ১৪), পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত
এবং বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং প্রেস ২১৯ ফকিরাপুল, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত।
ফোন: ০২-৪৭১২০৮৬০, ০২-৪৭১২০৮৬২, ই-মেইল : deltatimes24@gmail.com, deltatimes24@yahoo.com